শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

পাবনা জেলার ঐতিহ্য

পাবনা জেলার লোক সংঙ্গীত , লোকগাঁথা, লোকনৃত্য, কৌতুক, নকশা, পালাগান, ইত্যাদি লোকসংস্কৃতিতে অত্যমত্ম ঐতিহ্য মন্ডিত। অতি পুরাতনকাল হতেই এ জেলার বস্ত্র শিল্প প্রসিদ্ধ , গ্রামে গ্রামে বস্ত্র বয়নকারী হিন্দু মুসলমান উভয় জাতি সম্প্রদায় মিলে মিশে কাজ করে। হান্ডিয়ালের বিবরন প্রসংগে অবগত হওয়া যায় একমাত্র এখানেই কোম্পানি আমলের সমস্ত ভারতবর্ষের চার পঞ্চমাংশ রেশম আমদানি হত। পাবনার সাদুলনাপুর,সুজানগর,দোগাছি,শিবপুর,সিলিমপুরের সহ অনেক এলাকায় রয়েছে তাঁতী সম্প্রদায়। দোগাছির শাড়ী ও লুঙ্গী দেশ খ্যাত। পাবনা ব্যতীত অন্য কোথাও কাপড় প্রস্তত উপযোগী সূতা রংকারক দেখা যায় না। একটি সরকারী বিবরণী থেকে জানা যায় জেলার সাঁড়া , সাঁথিয়া , সুজানগর সহ অনেক এলাকায় ইক্ষু নির্ভর শিল্প রয়েছে। জেলায় প্রচুর পরিমানে সরিষা উৎপাদিত হয় , আর এর ফলে এখানে গড়ে উঠেছে অনেক তেল কল। পূর্বে খুলু সম্প্রদায় এই পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিল, যন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা আজ বিলুপ্ত পায়।

পাবনার ঐতিহ্যবাহী তাতশিল্প

তাঁত শিল্পে পাবনা জেলা সমৃদ্ধশালী। এখানকার শাড়ী, লুংগী ও গামছা বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। তাই তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋন দিয়ে পাবনার তাঁত শিল্পকে আরো উজ্জীবিত করা প্রয়োজন। তাঁত শিল্প উজ্জীবিত হলে বহু কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং শাড়ী, লুংগী, গামছা বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সক্ষম। বস্ত্র শিল্পের মধ্যে পাওয়ার লুম ২৪টি, চিত্র রঞ্জন তাঁত ১৪১৮ টি, হস্তচালিত তাঁত ৩৭৮১ টি, গেঞ্জি তৈরী ৩৬৫ টি, সুতা পাকানো ২০টি, এমব্রয়ডারী ২৭টি।

বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে অনেক ঐতিহ্য যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করে। নিমেন উল্লেখযোগ্য স্থানগুতলোর বর্ণনা দেয়া হলোঃ

ক) জোড়বাংলা মন্দিরঃ
পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে দক্ষিণ রাঘবপুরে শহরের পূর্ব-দক্ষিণে এ জোড়বাংলা মন্দিরটি অবস্থিত। ঘনবসতিপূর্ণ রাঘবপুরে একটি শান বাঁধানো পুকুরের কাছে মন্দিরটি দন্ডায়মান আছে। চারিদিকে এত বাড়িঘর তৈরী হয়েছে যে, বাইরের রাস্তা থেকে এ মন্দির দেখা যায় না। পাবনায় জোড়বাংলা মন্দিরে কোন শিলালিপি নেই। ব্রিটিশ শাসন আমলে যখন ইমারতটি প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষণের জন্য গৃহীত হয়েছিল তখনো এর কোন শিলালিপি ছিল
জোড় বাঙলা মন্দির, পাবনা

কিনা সে বিষয়ে কোনকিছু জানা যায়নি। স্থানীয় লোকমুখে প্রচলিত কাহিনীতে জানা যায় যে, ব্রজমোহন ক্রোড়ী নামক মুর্শিদাবাদের নবাবের এক তহশিলদার আঠার শতকের মধ্যভাগে এ মন্দির নির্মাণ করেন। এ মন্দিরটি আয়তনে বৃহৎ না হলেও বাংলাদেশের সকল জোড়বাংলা নিদর্শনের মধ্যে সুন্দরতম। এ স্থাপত্য নিদর্শনটি কেবল ইটের পর ইট গেঁথে নির্মিত একটি মারত নয় বরং শিল্পীর আপনমনের মাধুরী মিশিয়ে খন্ড খন্ড টেরাকোটা ফলকে রচিত স্থাপত্যের একটি সার্থক কাব্য।

খ) তাড়াশ জমিদার ভবনঃ
পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে বনমালী রায় বাহাদুরের তাড়াশ বিল্ডিং এখন পর্যন্ত প্রায় অক্ষত অবস্থায় আছে। পাবনার জমিদারদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা এবং পুরাতন বলে পরিচিত এই তাড়াশের জমিদার। সে সময়ের ভূস্বামী পরিবারগণই জমিদারবংশীয় বলে অভিহিত। বগুড়া জেলার চান্দাইকোণার কাছে ‘কোদলা’ গ্রামে একঘর কায়স্থ জমিদার ছিলেন; এই জমিদারই তাড়াশের রায়বংশের পূর্বপুরুষ বাসুদেব। তাড়াশের এই পরিবার ছিল পাবনা জেলার সবচেয়ে বড় জমিদার। বাসুদেব নবাব মুর্শিদকুলি খানের রাজস্ব বিভাগে চাকরি করে প্রতিষ্ঠা করেন রাজবাড়ী। নবাব মুর্শিদকুলি খান বাসুদেবকে ভূষিত করেন ‘রায়চৌধুরী’ খেতাবে। তার এষ্টেট ছিল প্রায় ২০০ মৌজা নিয়ে।

ছবিঃ রায় বাহাদুর বনমালী রায়

এই রায় বংশের বনমালীরায় ও বনওয়ারীলাল রায়ের নির্মাণ ঐতিহাবাহী বনমালী ইনস্টিটিউটও। জানা যায়, ১৯৪২ সনে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের আতঙ্কে এ জমিদার পরিবার তাদের পাবনা শহরে নির্মিত ঐতিহাসিক তাড়াশ বিল্ডিং এ আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাবনা অঞ্চলের সর্ববৃহৎ জমিদারকর্তৃক নির্মিত তাঁদের অমরকীর্তি পাবনা শহরের তাড়াশ বিল্ডিং আজও তাঁদের স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। আদিতে বনওয়ারীলাল ফরিদপুর থানার ডেমরাতে বসতি স্থাপন করেন এবং কালক্রমে এই স্থানের নাম হয় বনওয়ারীনগর। তাঁদের নির্মিত শহরের ভবনটি তাড়াশ রাজবাড়ী নামেও পরিচিত। পাবনা প্রাসাদোপম ভবনটির সম্মুখ ফাসাদ দ্বিতলবিশিষ্ট এবং চারটি সুডৌল বৃত্তাকার স্তম্ভ সহযোগে প্রাসাদের দ্বিতলের কক্ষটি নির্মিত। প্রাসাদের সামলে উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের শেষপ্রান্তে প্রবেশ ফটকটির দুপার্শ্বে দুটি করে চারটি স্তম্ভ এবং মাঝখানে বিশাল আকৃতির অর্ধবৃত্তাকার খিলানে প্রবেশপথটি সৃষ্ট। দৃষ্টিনন্দন প্রবেশপথটি সহজেই সকলের মন হরণ করে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন আমলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ রীতির প্রভাবে নির্মিত তাড়াশ জমিদারবাড়ী তাড়াশের জমিদার রায় বাহাদুর বনমালী রায়ের অর্থানুকূল্যের স্মৃতি নিয়ে জেগে আছে। তাড়াশ জমিদারদের পাবনা শহরে নির্মিত(রাজবাড়ী) প্রাসাদভবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট এর প্রবেশ তোরণ। ভবনটি আয়তাকৃতির এবং এর আয়তন দৈর্ঘ্যে ৩০.৪০ মিটার (১০০ ফুট) এবং প্রস্থ ১৮.২৮ মিটার(৬০ ফুট)। চারটি কোরিনথিয়ান স্তম্ভের উপরে আকর্ষনীয় দ্বিতল গাড়িবারান্দা সহজেই পথিকের দৃষ্টি আকর্ষন করে। তাড়াশ জমিদার ভবনের দুই পার্শ্বে দুটি বর্ধিত অঙ্গ সংযুক্ত রয়েছে এবং সর্বত্র অর্ধ বৃত্তাকৃতির খিলান সুষমভাবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। তাড়াশ রাজবাড়ী অনেক আগে থেকে সরকারী দফতর হিসেবে ব্যবহত হওয়ায় এখন পর্যন্ত সমসাময়িককালে নির্মিত অন্যান্য জমিদারবাড়ী থেকে ভালো অবস্থায় আছে এবং সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষিত ইমারতের তালিকাভূক্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে এ সম্পদ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষনের কাজ করে পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন করা হলে এটি একটি উল্লেখযোগ্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট খাতে আয়ের পথ সুগম করবে।

গ) শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ(আশ্রম-মন্দির), হেমায়েতপুর, পাবনাঃ
পাবনা শহরের সন্নিকটে হেমায়েতপুর গ্রামে শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ(আশ্রম-মন্দির) টি অবস্থিত। অনুকূল চন্দ্রের পিতা ছিলেন হেমায়েতপুর গ্রামের শ্রী শিবচন্দ্র চক্রবর্তী এবং মাতা ছিলেন শ্রী যুক্তা মনমোহিনী দেবী। সৎসঙ্গ আশ্রমটি আদিতে সাদামাঠা বৈশিষ্টে নির্মিত হয়েছিল; এতে কোন উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য বৈশিষ্ট পরিলক্ষিত হয়নি। তবে বর্গাকৃতির ভবনটির শীর্ষদেশ চারটি ত্রিভূজ আকৃতির ক্রমহ্রাসমান ছাদে আচ্ছাদিত ছিল। এ মন্দিরের শিখর ক্ষুদ্রাকৃতির কলস ফিনিয়ালে আকর্ষনীয় বৈশিষ্টমন্ডিত ছিল। মন্দিরের পাশেই শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের পূজার ঘর অবস্থিত। এ ক্ষুদ্র ভবনটি গম্বুজবিশিষ্ট এবং ধনুক বক্র কার্নিশ ও গম্বুজের চারকোণে চারটি দৃষ্টিনন্দন শিখর ধারণ করে এক বৈচিত্রময় বৈশিষ্টের অবতারনা করেছে।

ছবিঃ অনুকুল ঠাকুর আশ্রম

শ্রী শ্রী অনুকূল চন্দ্রের পিতা-মাতার স্মৃতিরক্ষার্থে এই মন্দির নির্মিত। মন্দিরের সম্মুখ প্রাসাদে ‘স্মৃতি মন্দির’ কথাটি পাথরের উপরে উৎকীর্ণ করা আছে। অনুকূলচন্দ্র ‘সৎসঙ্গ’ নামে একটি জনহিতকর সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। প্রকৃত অর্থে অনুকূল ঠাকুর মানবকল্যাণে তাঁর জায়গা-জমি যথাসর্বস্ব উৎসর্গ করে গেছেন। স্মৃতিমন্দিরটি অন্যান্য ইমারতের তুলনায় এখনো সুসংরক্ষিত অবস্থায় আছে। সম্প্রতি নব নির্মিত সৎসঙ্গ-আশ্রম-মন্দির সমন্বয়ে গঠিত স্থাপত্য নিদর্শনটি সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে। এখানে শ্রী শ্রী অনুকূল চন্দের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঐ সময় এখানে প্রচুর লোক/অতিথির সমাগম হয়। প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় বলে জানা যায়। ভারত হতেও লোকজন এখানে আসেন। এ সম্পদের প্রয়োজনীয় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ জরুরী। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে আশ্রম এলাকায় প্রয়োজনীয় পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন করা হলে সারা বছরই এখানে দেশী/বিদেশী পর্যটকগণ আসা/যাওয়া করবেন। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য একটি টুরিষ্ট স্পট হিসেবে বিবেচিত হবে ও সংশ্লিষ্ট খাতে আয়ের পথ সুগম করবে।

ঘ) মানসিক হাসপাতাল, হেমায়েতপুর, পাবনাঃ


পাবনা হেমায়েতপুরের মানসিক হাসপাতাল শহরের সন্নিকটে আনুমানিক ৩ কিঃ মিঃ পশ্চিমে অবস্থিত। এটি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পাবনা মানসিক হাসপাতাল মানসিক চিকিৎসায় দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। জানা যায়, এখানে রোগীদের প্রতিদিন গড় অবস্থানের সংখ্যা ৪২৫-৪৫০ জন। হাসপাতালটি দীর্ঘদিনের পুরানো বিধায় এটির সার্বিক মেরামত/সংস্কার খুবই প্রয়োজন।

ঙ) ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীস্থ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালনশাহ সেতুঃ


পাবনা জেলা সদর হতে ঈশ্বরদী উপজেলার দুরত্ব আনুমানিক ২৫-৩০ কিলোমিটার। যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল। ঈশ্বরদী উপজেলার ১টি ইউনিয়ন ও গ্রামের নাম পাকশী। হার্ডিঞ্জ ব্রীজের পাশে এবং পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। পাকশী
হার্ডিজ ব্রীজ, পাবনা

লালন শাহ সেতু

গ্রামে বাংলাদেশের রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে বিভাগীয় হেডকোয়ার্টার অবস্থিত। এছাড়াও পাকশী একটি প্রধান ব্রডগেজ রেলওয়ে স্টেশন। এ স্টেশনের আধা মাইল উত্তরে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান রেলওয়ে অফিসগুলো ও কলোনী অবস্থিত। কলোনীর সুদৃশ্য ভবনগুলিতে রেল বিভাগের বিভিন্ন অফিসমূহ অবস্থিত। এ কলোনীর অভ্যন্তরে সকল রাস্তাই পাকা এবং চারপাশে বহু সংখ্যক বড় বড় বৃক্ষ সারি দিয়ে শোভিত। এর পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত পদ্মার দৃশ্য অতীব নয়নাভিরাম। পাকশী থেকেই বাংলাদেশ রেলওয়ের বৃহত্তম সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রীজ পদ্মা বক্ষ অতিক্রম করেছে। পাকশী সন্নিকটে এবং পাকশী ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্গত রূপপুর গ্রামে প্রস্তাবিত আণবিক প্রকল্পের স্থান নির্বাচন করা আছে। ব্রীজ সংলগ্ন স্থানে বেশ কিছু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কটেজ রয়েছে যেখানে দেশী বিদেশী পর্যটক অবস্থান করে পদ্মার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।

ছ) ফরিদপুরের স্মৃতিঘেরা রাজবাড়ীঃ
পাবনা জেলা সদর হতে ফরিদপুর উপজেলার দুরত্ব আনুমানিক ৪৫-৫০ কিলোমিটার। যাতায়াত ব্যবস্থা ভাল। ফরিদপুরের জমিদার ও রাজবাড়ী উপজেলার ঠিক কেন্দ্রস্থলে কিংবদন্তী হয়ে রয়েছে। সিরাজগঞ্জের তাডাশের জমিদার বনওয়ালী লাল রায় তাড়াশ থেকে পাবনা যেতেন ফরিদপুর চিকনাই নদী দিয়ে ঢুকে ইছামতি দিয়ে। বনওয়ালী লাল রায়ের পূর্ব পুরুষ ছিলেন ‘‘চৌধুরাই তাড়াশ’’ এর জমিদার বাসুদেব তালুকদার। তিনি ঢাকার ইসলাম খার সরকারী চাকুরী করতেন। নবাব তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ‘‘চৌধুরাই তাড়াশ’’ নামক সম্পত্তি তাকে জায়গীর হিসাবে দান করে ‘‘রায় চৌধুরী’’ উপাধি দেন। তৎকালীন পরগা কাটার মহল্লা রাজশাহীর সাতৈলের রাজার জমিদারী ছিল। এর ২০০ মৌজা নিয়েই ‘‘চৌধুরাই তাড়াশ’’ জমিদারী সৃষ্টি হয়। ফরিদপুর থানার বর্তমান বনওয়ারী নগর এলাকা গভীর বন জঙ্গলে পরিপুর্ণ শিকার উপযোগী স্থান হওয়ায় মাঝে মধ্যেই বনওয়ারী লাল রায় এ স্থানে শিকার করতে আসতেন। জনশ্রুতি রয়েছে, ষোড়শ শতাব্দীর একেবারেই শেষ দিকে লাটের খাজনা দিতে পাবনা যাওয়ার পথে ফরিদপুর থানার বর্তমান রাজবাড়ীর স্থলে বনওয়ারী লাল বিশ্রামের জন্য তাবু খাটান। বিশ্রামের সময় জঙ্গলের পার্শ্বে ‘‘ভেঙ কর্তৃক সর্প ভক্ষণের’’ দৃশ্য দেখলেন। এ দৃশ্য দেখে স্থানটি অতীব সৌভাগ্যের মনে করে তিনি তাড়াশের জমিদার বাড়ীর অনুরূপ চারদিকে দীঘি


খনন করে মাঝখানে সুন্দর বাড়ী নির্মাণ করে তার নাম অনুসারে এ স্থানের নাম বনওয়ারী নগর রাখেন। পরে তাড়াশ থেকে জমিদারির প্রধান অংশ বনওয়ারী নগরে হস্তানন্তর করেন। জমিদার বনওয়ারী লাল রায়ের স্থাপত্য শিল্পে যে প্রখর জ্ঞান ছিল তার প্রমাণ মেলে তারই নির্মিত চারদিকে দীঘি বেষ্টিত একমাত্র প্রবেশ পথ সমৃদ্ধ রাজবাড়ীটির স্থান নির্ধারণ, গঠন ও নির্মাণ শৈলী দেখে। প্রবেশ পথ দিয়ে রাজবাড়ীতে ঢুকতেই হাতি, তীরন্দাজ, ময়ূর ইত্যাদির মুর্তি খচিত গেট বিল্ডিং খুবই চিত্তাকর্ষক। গেট দিয়ে ঢুকে ডান দিকে জমিদারের একতলা রাজস্ব অফিস। এখানে জমিদারের খাজনা আদায় ও প্রজাদের অভাব অভিযোগ শ্রবণের কাজ হতো। বিল্ডিংটির সুন্দর কারুকাজ এবং গাম্ভীর্য এতই গভীর যে, এখানে ঢুকলে বাসতবিকই দূর অতীতের রাজাদের আমলে মন ফিরে যায় এবং নিজেকে জমিদার বলে খানিকটা ভাবতে ইচ্ছে হয়। এ বিল্ডিং থেকে প্রয় ১শ গজ দক্ষিণ পশ্চিম কোণে দোতলা বিল্ডিংটি ছিল কয়েদ খানা এবং টাক শাল। এখানে মোটা মোটা লোহার গ্রিল ও দরজা এবং অন্ধকার কুঠুরি জমিদারদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথা স্মরণ করে দেয়। যদিও এ জমিদার তেমন প্রজাপীড়ন করেননি।  ডান পাশে মাটির নীচে লোহার সিন্দুকে রাজস্ব আদায় করে রাখা হতো। জানা যায়, উপজেলা পদ্ধতি চালুর পূর্বে বিল্ডিং সংস্কার করার সময় এই সিন্দুকে প্রায় ২৫ লাখ টাকা মূল্যের কাঁচা ধাতব মুদ্রা পাওয়া যায়। বর্তমানে এ বিল্ডিংটি সমাজসেবা, প্রকল্প বাসতবায়ন এবং আনসার ও ভিডিপি অফিস হিসাবে ব্যবহ্নত হচ্ছে। এটি থেকে প্রায় ১শ গজ দক্ষিণে জমিদারের মুল বাসভবন। বাসভবন সংলগ্ন দক্ষিণে দীঘির পানির মধ্যে তিনটি ধাপে ছাদবিহীন বিল্ডিংয়ের মত গোসলখানা ও রানীর ঘাট। জমিদার পরিবারের মেয়েদের আভিজাত্য এবং কড়াকড়ি পর্দার কারণে এ রকম গোসলের ঘাট তৈরী হয়। মূল ভবন এখন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসা। সংস্কারের ফলে বিল্ডিংয়ের কারুকাজ ও নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল বাসভবনের অনতি দুরেই দিঘির পাড় সংলগ্ন দক্ষিণ মুখী জমিদারের হাওয়া খানা। বর্তমানে এটি উপবৃত্তি অফিসারের অফিস হিসাবে ব্যবহ্নত হচ্ছে। এর ১শ গজ পূর্বে একসঙ্গে লাগানো একতলা বিনোদবিগ্রহ মন্দির ও দোতলা নাট্য মন্দির। এ মন্দির দুটির বৈশিষ্ট হলো, এর গায়ে ছিল হাতি, ঘোড়া, সাপ, তীরন্দাজ খচিত মূর্তি সম্বলিত বিভিন্ন ধরণের অপূর্ব নকশা। নাট্য মন্দিরের দোতলায় বসেই বিনোদবিগ্রহ মন্দিরের সকল পূজার্চনা ও নাট্য মন্দিরের নাচগান ও অভিনয় দেখা যেত। সুদূর কলকাতার অভিনেতা ও জমিদাররাও এখানে আসতেন এবং অভিনয় করতেন। বর্তমানে এটি অফিসার্স ক্লাব হিসাবে ব্যবহ্নত হচ্ছে। রাজবাড়ী থেকে প্রায় এক হাজার গজ পূর্ব দিকে জমিদারের প্রতিষ্ঠিত দুধ সাগরের পশ্চিম দক্ষিণ পাড় প্রজাদের শিক্ষানুরাগী করে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সরোদ গনপাঠাগার। পাঠাগারটির বৈশিষ্ট হলো, এর চারিদিকে খোলা বারান্দা, দরজা ও জানালা। দক্ষিণ দিকে তৎকালে ১০/১২ মাইল পর্যন্ত কোন গ্রাম ছিলনা। ভবনগুলোর বর্তমানে বেশ খানিকটা বেহাল অবস্থা। এ ইতিহাসখ্যাত রাজবাড়ীর মেরামত/সংস্কার জরুরী। এ রাজবাড়ীটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াসে বিষয়টি জেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটিতে আলোচনান্তে এর মেরামত/রক্ষণাবেক্ষণ এবং পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পর্যটন সুবিধা প্রবর্তনের নিমিত্তে গঠিত উপ-কমিটি কর্তৃক একটি সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রাক্কলন তৈরী করা হয়। এতে ২ কোটি টাকার একটি প্রাক্কলন ধরা হয়। সংশিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে এর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় পর্যটন সুবিধাদি প্রবর্তন করা হলে এটি একটি উল্লেখযোগা স্পট হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং পাশাপাশি এই খাতে আয়ের পথ সুগম করা সম্ভব হবে।

জ) পাবনা এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজঃ
স্বনামধন্য এ কলেজটি ১৮৮৯ সালের জুলাই মাসে স্থাপিত হয়। এটি জেলার প্রাচীন এবং সর্ববৃহৎ মহাবিদ্যালয়। তৎকালীন ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের স্মৃতির স্মরণে ১৯১১ সালের এর নামকরণ করা হয় এডওয়ার্ড কলেজ। তৎপূর্বে এর নাম ছিল পবানা ইনস্টিটিউট। কলেজটি স্থাপনের সময় রায় বনমালী রায় বাহাদুর(জমিদার), অধ্যাপক হেম চন্দ্র রায় (দাতা), গোপালচন্দ্র লাহিড়ী, রাধিকা নাথ বসু প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের বিশেষ ভূমিকা ছিল।
১৯৬৮ সালের ১ মার্চ তারিখে কলেজটি সরকারীকরণ করা হয়। উত্তর বাংলার এই বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদের জন্য পৃথক চত্বরে সর্বোচ্চ তিনতলা পর্যন্ত প্রাসাদোপম ভবনে বর্তমানে কয়েকটি বিষয়ে সনাতকোত্তর কোর্স চালু করার মাধ্যমে এটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মর্যাদা লাভ করেছে।

ঝ) বনমালী ইনস্টিটিউটঃ
উপমহাদেশের বরেণ্য নানা গুনীজনের, দেশী বিদেশী অভিথিবৃন্দের এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আগমনের স্মৃতিঘেরা ঐশ্বর্যের কিংখাবে আকীর্ণ নাম বনমালী ইনস্টিটিউট। যুগের দাবীকে মেটাতে ১৯২৪ খ্রিস্টাবে্দর ৫ মার্চ এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বনমালী হল, কান্ত মেমোরিয়াল স্টেজ ও কিশোরী মোহন স্টুডেন্টস লাইব্রেরী ও অফিস প্রতিষ্ঠাকালীন পরিকল্পনায় তিনে মিলে আজকের বনমালী ইনস্টিটিউট। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী পেশা নির্বিশেষে সংস্কৃতিমোদী নাগরিকবৃন্দের মতামত আহরণের সম্মিলন কক্ষঃ বনমালী হল, নাগরিকগণের প্রয়োজন উপস্থিাপনযোগ্য সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকান্ডের প্রদর্শনার্থেঃ কান্ত মেমোরিয়াল হল ও মুক্তিবুদ্ধির চর্চার লালন, প্রসারণে উজ্জীবিত করতেঃ কিশোরী মোহন স্টুডেন্টস লাইব্রেরী ও অফিস। এই তিন আন্তরিক ইচ্ছাকে বুকে লালন করেই কালের যাত্রায় সুসময়-দুঃসময়ের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বনমালী ইনস্টিটিউট আজ তার প্রতিষ্ঠার বাহাত্তর বছর অতিক্রম করছে।

শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

পাবনাঃ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা

১৯৪৭ সনে দ্বিজাতি-তত্বের ভিত্তিতে ভারত বর্ষ বিভক্ত হয়। অবৈজ্ঞানিক দ্বিজাতী-তত্ব অসার প্রমাণিত হয়। বাঙ্গালী জাতীয়বাদের উন্মেষ ঘটে। ১৭৭১ সনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিপুল রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। রক্তমূল্যে স্বাধীনতায় পাবনা জেলার অবদান উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাবনা জেলা ছিল ৭নং সেক্টরের অধীন। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লেঃ কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান। পাবনা জেলা স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে শেষ পর্যমত গৌরবজ্জল ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে অবদান রেখেছে এ জেলার সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ও সর্বস্তরের জনগণ। অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এ জেলার হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। বার বার মোকাবেলা করেছে পাক-হানাবার বাহিনীকে। মুক্ত রেখেছে জেলার বেশ কিছু স্থান। এ জেলার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন ছাত্র-জনতা, রানৈতিক নেতা-কর্মী, সর্বস্তরের জনতা ও পাবনায় অবস্থানরত সকল পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। অনেক নেতা-কর্মী পালন করেছেন সংগঠনের গুরু দায়িত্ব। পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের সচিত্র বনর্না ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ শুক্রবার সকাল থেকে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী পৈশাচিক আক্রমন শুরু করল পাবনার সাধারণ মানুষের উপর। শহরে থাকা নিরাপদ নয় বুঝতে পেরে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ শহরের উপকন্ঠে চর এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সহিত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করার শপথ গ্রহণ করেন পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান। এখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করেছেন যারা, আমজাদ হোসেন এমএনএ, আব্দুর রব বগা মিয়া, এ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন, এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, ওয়াজ উদ্দিন খান, এ্যাডভোকেট গোলাম আলী কাদেরী, নবাব আলী মোল্লা, ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম বকুল, (পাবনার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান) ইকবাল হোসেন, আব্দুস ছাত্তার লালু, সোহরাব উদ্দিন সোবা, রিদ্দিক আলী, বেবী ইসলাম প্রমূখ। ১৭৭১ সালের ২৮শে মার্চ ভোর রাত্রে পাকহানাদার বাহিনী পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমন করে। পাবনার অকুতভয় পুলিশ বাহিনী জীবন বাজী রেখে পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমন প্রতিহত করে। পাবনার পুলিশ লাইনের যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সহিত পাবনার ছাত্র-জনতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বিপুল পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করে পাকবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পাকহানাদার বাহিনী পুলিশ লাইন থেকে পিছু হটে তাড়াশ বিল্ডিং সংলগ্ন টেলিফোন একচেঞ্জে এসে পজিশন নেয়। সকাল ৯.০০ ঘটিকার সময় রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাবনার ছাত্র-জনতা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ টেলিফোন একচেঞ্জে অস্থানরত পাকহানাদার বাহিনীর উপর আক্রমন চালায়। এই যুদ্ধে প্রায় অধিকাংশ পাকহানাদার মৃতুবরণ করে এবং কিছু সংখ্যক পাকহানাদার গুলি করতে করতে শহরের বিভিন্ন প্রামেত চলে যায়। পাবনা শহরের ময়লাগাড়ী নামক স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর সহিত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতার যুদ্ধ সংগঠতি হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন পাকহানাদার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। পাবনা প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠিত হয় ১৭টি স্থানে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য পাবনা পুলিশ লাইন, টেলিফোন একচেঞ্জ, ময়লাগাড়ী, সার্কেট হাউস সংলগ্ন কাঠের ব্রীজ, বিসিক, মাধপুর বটতলা, ঈশ্বরদী বিমান বন্দর, দাশুড়িয়া তেতুল তলা, মূলাডুলি, মালিগাছা উল্লেখযোগ্য। ২৫শে মার্চ রাত্রিতে পাবনায় পাঠানো প্রায় ১৫০জন পাক হানাদার বাহিনীর সকলেই নিহত হয়। ১৩ দিন পাবনা মুক্ত ছিল। ১৩ দিন পাবনা মুক্ত থাকার পর পুনরায় ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকহানাদার বাহিনী পুনরায পাবনায় ঢোকার মুখে নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র জনতার উপর জলে স্থলে ও আকাশ থেকে আক্রমন চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটে আশে পাবনায়। কিছু মুক্তিযোদ্ধা পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার ডাব বাগান নামক স্থানে অবস্থান নেয়। সেখানে পাকহানাদার বাহিনীর সহিত তুমূল যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। পাকহানাদার বাহিনীর ১৩ জন সদস্য নিহত হয়। ঐ যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ঐ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে শহীদনগর। পুনরায় পাকবাহিনী পাবনা দখল করায় মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র জনতা ভারতে গমন করে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাবনায় প্রবেশ করে এবং পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতির্ন হয়। ঈশ্বরদী থানা পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার উল্লেখযোগ্য যুদ্ধস্থান জয়নগর ও ঈশ্বরদী বিমান বন্দর। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কোম্পানী কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম মন্টু, সদরুল হক সুধা, আজমল হক বিশ্বাস, নুরুজ্জামান বিশ্বাস, শামছুর রহমান শরিফ ডিলু প্রমুখ। আটঘরিয়া থানা পাবনা জেলার আটঘরিয়া থানার বংশীপাড়া নামক স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর সহিত সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ আটঘরিয়া থানার মধ্যে সর্ববৃহৎ লড়াই বা উল্লেখযোগ্য। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বিএলএফ কমান্ডার আনোয়ার হোসেন রেনু, এফএফ কমান্ডার ওয়াসেফ আলী, আশরাফ আলী, জহুরুল হক প্রমূখ। চাটমোহর থানা পাবনা জেলার চাটমোহর থানার উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সংগঠতি হয় চাটমোহর থানা দখলের যুদ্ধে। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মোজাম্মেল হক ময়েজ, এস.এম মোজাহারুল ইসলাম, চঞ্চল প্রমূখ। ভাঙ্গুড়া থানা পাবনা জেলার বর্তমান ভাঙ্গুড়া থানার বড়াল ব্রীজ নামক স্থানে ও দিলপাশার নামক স্থানে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার হান্নান সাহেব, আসলাম, মকছেদুর রহমান প্রমূখ। পাবনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বুকলের নাম। পাবনা জেলার সকল এলাকার যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের সমন্বয়কারী, যুদ্ধের পরিকল্পনাকারী ও সর্বপোরী পাবনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাবনার মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক রফিকুল ইসলাম বকুলকে শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করি। সেই সঙ্গে স্মরণ করি সকল শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের। ১৫ই ডিসেম্বর পাবনা শত্রু মুক্ত হয়। পাবনার বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পত পত করে উড়তে থাকে।

পাবনা জেলার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

ঐতিহ্যে সমৃদ্ধময় নদীমাতৃক জেলা পাবনা। এর মাটির গন্ধ, শ্যামল প্রকৃতি মনে রেখাঙ্কন করে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এ জেলার অবদান নগন্য নয়। কালের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে আবির্ভাব ঘটেছে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের। এই সব শিল্পীর অনবদ্য অবদানে আমাদের সাহিত্য হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী পাবনা জেলার যে সব শিল্পী-সাহিতিাকের নাম এতে আলোচিত হয়েছে, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের বিশেষ ভুমিকা লক্ষ্যণীয়। প্রথমে কবিতা প্রসংগে আলোচনা করা যেতে পারে। মধ্যযুগে পাবনা জেলার যে সব কবির নাম মেলে তার মধ্যে অদ্ভুত আচার্য বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী। রামায়ণ-অনুবাদক হিসাবে তিনি পরিচিতি। কবির সময়কাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে এ জেলার কৃষ্ণকিশোর রায়, শশধর রায় মধ্যযুগের মতো পাঁচালীর অনুকরণে কাব্য রচনা করেছেন। এ জেলার কবিদের রচিত অন্যান্য উল্লেখ্য কাব্যের মধ্যে প্রসন্নময়ী দেবী বিরচিত ‘নীহারিকা’, রজনীকান্ত সেনের ‘বাণী’ ও ‘অমৃত’, প্রমথ চৌধুরীর ‘সনেট পঞ্চাৎ’ ও ‘পদচারণ’, প্রিয়মব্দা দেবীর ‘রেণু’ এর মধ্যে সমকালীন সমাজ চিত্রে প্রসন্নময়ী দেবী, সনেটে প্রমথ চৌধুর, শোক কাব্যে প্রিয়ম্বদা দেবী, ঐতিহ্য বিষয়ক রচনায় আবুল হাশেম ও পল্লী কবিতায় বন্দে আলী মিয়ার নাম স্মরণীয়। আবু লোহানী প্রমুখ এক বা একাধিক কাব্য লিখেছেন। তাঁদের অনেকেই বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, সে তুলনায় সাহিত্য অঙ্গনে ততটা পরিচিতি লাভে সমর্থ হননি। সাম্প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ মৈত্র, মণীন্দ্র রায়, বাণী রায়, আব্দুল গণি হাজারী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে সংখ্যাগত প্রাচুর্য ও সৃষ্টির বিচিত্রতায় সবচেয়ে প্রদীপ্ত নাম মণীন্দ্র রায়ের। যুগ যন্ত্রণা এবং একই সঙ্গে রোমান্টিকতা তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে। মণীন্দ্র রায়ের ‘মুখের মেলা’, ‘মোহিনী আড়াল’, ‘এই জন্মঃ জন্মভুমি’ কাব্যত্রয়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘রাজধানী ও মধুবংশীয় গলি’, বাণী রায়ের ‘জুপিটার’, তরুণ সান্যালের ‘মাটির বেহালা’, আব্দুল গণি হাজারীর ‘সূর্যের সিড়ি’, জিয়া হায়দারের ‘একাত্তরের কান্না’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘আপন যৌবন বৈরী’, দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ ইত্যাদি কাব্য বাংলা কবিতার ধারার উল্লেখ্য সংযোজন। এদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। মণীন্দ্র রায় ১৯৬৯ সনে তাঁর ‘মোহিনী আড়াল’ কাব্যের জন্য ‘সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার’, আর আব্দুল গণি হাজারী ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ লিখে ১৯৬৪ সনে ‘এশীয় কাব্য পুরস্কার’ লাভ করেছেন। তরুণতম দাউদ হায়দার রচিত ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতাটি লন্ডনের আন্তর্জাতিক কবিতা সমিতি কর্তৃক ১৯৭২ সনের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। ছড়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট নাম বন্দে আলী মিয়া। উপেন্দ্র কিশোর চৌধুরী সম্পাদিত বিখ্যাত শিশু-সাময়িকী ‘সন্দেশ’-এ নিয়মিত লিখতেন প্রসন্নময়ী দেবী। মণীন্দ্র রায় ব্যাঙ্গাত্মক ছড়ার ক্ষেত্রে বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। গজল রচনার ক্ষেত্রে উল্লেখ্য নাম আবুল হাশেম। আধুনিক গানের ক্ষেত্রে আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, ফজলে খোদা প্রমুখের নাম করা যেতে পারে। ছোট গল্পের ক্ষেত্রে কাহিনীর চকমপ্রদ বৈশিষ্ট ও রূপ সৃষ্টির অনন্যতার দিক থেকে প্রমথ চৌধূরীর নাম প্রথমেই উচ্চার্য। তার গল্প সংগ্রহ ‘চার ইয়ারী কথা’, ‘নীল লোহিত’। বাণী রায়ের একটি অত্যন্ত স্মরণীয় সৃষ্টি ‘ময়নামতির কড়চা’। সরদার জয়েন উদ্দিন এর গল্পের বিষয় গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের আলেখ্য। এ ক্ষেত্রে সরদার জয়েন উদ্দিনের বিশেষ সংযোজন-খরশ্রোতা, ‘নয়ান ঢুলী’। এ জেলার অন্যান্য গল্পকারদের মধ্যে বন্দে আলী মিয়া, ফতেহ লোহানী, রশীদ হায়দার প্রমুখের নাম স্মরণীয়। এর পর বাংলা ১২৯৬ সনে বের হয় ‘অশোকা’ রচয়িতা প্রসন্নময়ী দেবী। এ জেলার অন্যানা উপন্যাসিকের মধ্যে আবুল হাশেম, বন্দে আলী মিয়া, বাণী রায়, সরদার জয়েন উদ্দিন, রশীদ হায়দার প্রমুখের নাম উল্লেখ যোগ্য। এর মধ্যে বন্দে আলী মিয়া, বাণী রায় ও সরদার জয়েন উদ্দিনের উল্লেখ্য সংখ্যক উপন্যাস রয়েছে। এ জেলার উপন্যাসিকদের বিশেষ স্মরণীয় সৃষ্টি- রাধাচরণ চক্রবর্তীর ‘মৃগয়া’, বাণী রায়ের ‘প্রেম’, ‘কনে দেখা আলো’, সরদার জয়েন উদ্দিনের ‘অনেক সূর্যের আশা’, রশীদ হায়দার বিরচিত ‘খাঁচায়’। কৌতুক নাট্য রচনায় পরিমল গোস্বামাী বিশেষ সিদ্ধহস্ত। এ ক্ষেত্রে তাঁর সংযোজন- ‘ঘুঘু’, ‘দুষ্মন্তে বিচার’। আবুল হাশেম, বন্দে আলী মিয়া, মণীন্দ্র রায় মুলতঃ নাট্যকার নন। একাধিক নাটক এদের রয়েছে। এর মধ্যে আবুল হাশেমের ‘মাষ্টর সাহেব’, বন্দে আলী মিয়ার ‘মসনদ’ ও মণীন্দ্র রায়ের ‘ভীষ্ম’(কাব্য নাট) ও ‘লখীন্দর’ ইত্যাদি নাম করা চলে। এ ছাড়া জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার বিশিষ্টতা পরিচয় দিয়েছেন। এদের রচনা সংখ্যা সীমিত হলেও বিষয়বস্তু ও শিল্পগত দিক থেকে স্মরণীয়। ভ্রমণ বিষয়ক প্রথম উল্লেখ্য রচনা ‘আর্যবর্ত্য’(১২৯৫)। লেখিকা প্রসন্নময়ী দেবী। পরিমল গোস্বামীর এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান - ‘পথে পথে’ । স্মৃতিকথামূলক রচনা এ জেলায় কিছু পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট নাম প্রসন্নময়ী দেবী। এর রচনা-‘পূর্ব স্মৃতি’। এরপর আত্মকথা লিখেছেন প্রমথ চৌধুরী। এতে হরিপুর, পাবনার স্মৃতি রোমন্থন লক্ষিত হয়। এছাড়া বাংলা ১৩৩৩ সালের কার্তিক সংখ্যা ‘সবুজ পত্রে’ তিনি ‘পাবনার কথা’ নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন। পরিমল গোস্বামীর স্মৃতিচারণমুলক স্মরণীয় সৃষ্টি ‘পত্রস্মৃতি’ ও ‘আমি যাঁদের দেখেছি’। অতীত স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে বন্দে আলী মিয়ার রচনা ‘জীবনের দিনগুলি’। স্মৃতি কথার চেয়ে তুলনামূবকভাবে জীবনচরিত এ জেলায় রচিত অধিক জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে বন্দে আলী মিয়ার ‘জীবন শিল্পী নজরুল’ স্মরণীয়। জীবনকথা বিষয়ক প্রবন্ধে এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে পরিমল গোস্বামী, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, আবু লোহানী প্রমুখ বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। অনুবাদের ক্ষেত্রেও এ জেলার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রসন্নময়ী দেবীর ‘বনলতা’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা ইংরেজী থেকে অনুদিত। কুমুদনাথ চৌধুরী রচিত 'Sports in jheels and jungle’ অনুবাদ করেছেন প্রিয়মব্দা দেবী। এর অনুদিত ‘ঝিলে জঙ্গলে শিকার’ সবুজপত্রের কয়েকটি সংখ্যায় বের হয়। পরিমল গোসাম্বী অনুদিত অন্যতম উল্লেখ্য গ্রন্থ ‘সুখের সন্ধানে’ (মূলঃ বারট্রাগু বাসোল)। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন রুমীর ‘মসনবী শরীফের’ আংশিক অনুবাদ করেছেন। বাণী রায়ের ‘জুপিটার’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা ইংরেজী থেকে অনুদিত। এবং অনুদিত গদ্য রচনা- ‘মোনালিসা’, খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত এপুলিয়াস- এর `Golden ass’ অবলম্বনে আব্দুল গণি হাজারী অনুবাদ করেছেন ‘স্বর্ণ গর্দভ’। এ ক্ষেত্রে তাঁর আর এক উল্লেখযোগ্য প্রয়াস ‘মনসমীক্ষা’ (মূল ফ্রয়েড)। আর্থার মিলার রচিত `Death of a Salesman’ অবলম্বনে ফতেহ লোহানীর রচনা ‘একটি সামান্য মৃত্যু’। ইউীন ও নীল- এর নাটকের অনুবাদ ‘বিলাপে বিলীন’। কবি বন্দে আলী মিঞা শিশু সাহিত্যেও পাবনা জেলার বিশিষ্ট ভুমিকা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এ জেলায় উল্লেখ্য সংখ্যক শিশু সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে প্রসন্নময়ী দেবী, প্রিয়মব্দা দেবী, মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন ও বন্দে আলী মিয়া প্রমুখের নাম করা চলে। এর মধ্যে সংখ্যাগত দিক থেকে বন্দে আলী মিয়ার বইয়ের সংখ্যা পর্যাপ্ত। এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬২ সনে তিনি ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করেছেন। প্রবন্ধের ক্ষেত্রে পাবনা জেলার অবদান ব্যাপক। প্রথমে সাহিত্য সমালোচনা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধের কথা আলোচনা করা যেছে পারে। এতে প্রমথ চৌধুরী, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, ডঃ আবু হেনা মোসতফা কামাল ও জিয়া হায়দার প্রমুখের নাম স্মরণীয়। বাংলা গদ্যের বিবর্তনে ও প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারায় প্রমথ চৌধুরীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য অবদান ‘বীরবলের হালখাতা’, ‘নানা কথা’, ‘নানা চর্চা’। বাগবৈদগ্ধ্য তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর আধুনিক সাহিত্যের ওপর গবেষণায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ডঃ আবু হেনা রচিত গবেষণা নিবন্ধ- `The Bengli press and Literary writings, ১৮১৮-১৮৩১ ও সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘শিল্পীর রুপান্তর’-এ মনস্বিতার পরিচয় মেলে। রম্য রচনার ক্ষেত্রে পরিমল গোস্বামী বিশেষ সিদ্ধহস্ত। নির্মল কৌতুকের প্রচ্ছন্ন লক্ষিত হয় তাঁর রচনায়। পাবনা জেলার সাহিত্য সাধনার নেপথ্যে সাময়িক পত্রের অবদান্ত কম নয়। অনেক সাময়িকী এ জেলা থেকে বের হয়েছে। এর মধ্যে ‘পাবনা দর্পণ’, ‘উদ্যোগবিধায়নী’, ‘আশালতা’, ‘সৎসঙ্গী’, ‘সাম্যবাদ’, ‘সুরাজ’, ‘আমাদের দেশ’, ‘যমুনা’, ‘প্রবাহ’ ও ‘বিবৃতি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এ জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, নানা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত কিংবা যৌথ উদ্যোগে বেশ কিছু বার্ষিকী ও স্মরণিকা বের হয়েছে। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, সাহিত্যক্ষেত্রে পাবনা জেলার ভুমিকা শুধু ব্যাপকইনয়, সুদুরপ্রসারী প্রভাববাহীও বটে। মতিউর রহমান নিজামী পাবনার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তিনি দুইবার সংসদ সদস্য হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর আমীরি। সাহিত্য অংগনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অংগনেরও অনেক কৃতি মানুষের জন্ম হয়েছে পাবনায়। এদের অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে শুধু নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সঙ্গীতে বারীণ মজুমদার, ইলা মজুমদার, প্রমথনাথ চৌধুরী, আব্দুল গফুর, সত্য মজুমদার, মনোয়ারা বেগম, ডলি সায়ন্তনী, বাদশা বুলবুল উল্লেযোগ্য। এছাড়াও অন্য জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও চাকরী/কর্ম সূত্রে পাবনাতে দীর্ঘদিন অবস্থানকালীন সময়ে সাহিত্য সাধনা করেছেন এমন সাহিত্যিকদের সংখ্যাও কম নয়। তন্মধ্যে সরদার আব্দুল হামিদ, কবি আশুতোষ বড়ুয়া প্রমুখ। কিংবদন্তি নায়িকা সূচিত্রা সেন অভিনয় শিল্পকে আলোকিত করেছেন অনেকেই। যেমনঃ সুচিত্রা সেন, তপন লাহিড়ী, আবুল হোসেন, তেজেন চক্রবর্তী, নিশি বকশী। এর মধ্যে অত্যন্ত গর্বের সাথে উল্লেখযোগ্য নাম উপমহাদেশের কিংবদন্তি নায়িকা সূচিত্রা সেন। তার বাবা করুনাময় দাশ গুপ্ত। চাকরি করতেন পাবনা পৌরসভায়। সূচিত্রা সেন বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে বাস করতেন পাবনায়। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন পাবনা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পাবনাবাসি বর্তমানে পাবনা শহরের পুরান টেকনিক্যাল স্কুলের রাস্তার উত্তরে অবস্থিত তার পৈত্রিক বাড়ীকে কেন্দ্র করে সূচিত্রা সেন এর স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

ঐতিহ্যবাহী পাবনার শিল্প ও বাণিজ্য

এডরুক লিমিটেড, পাবনাঃ শিল্প ও ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে পাবনা জেলা আদিকাল থেকেই প্রসিদ্ধ ছিল। অতি পুরাতনকাল হতেই এ জেলার বস্ত্র শিল্প প্রসিদ্ধ , গ্রামে গ্রামে বস্ত্র বয়নকারী হিন্দু মুসলমান উভয় জাতি সম্প্রদায় মিলে মিশে কাজ করে। হান্ডিয়ালের বিবরন প্রসংগে অবগত হওয়া যায় একমাত্র এখানেই কোম্পানি আমলের সমস্ত ভারতবর্ষের চার পঞ্চমাংশ রেশম আমদানি হত। পাবনার সাদুলনাপুর,সুজানগর,দোগাছি,শিবপুর,সিলিমপুরের সহ অনেক এলাকায় রয়েছে তাঁতী সম্প্রদায়। দোগাছির শাড়ী ও লুঙ্গী দেশ খ্যাত। পাবনা ব্যতীত অন্য কোথাও কাপড় প্রস্তত উপযোগী সূতা রংকারক দেখা যায় না। একটি সরকারী বিবরণী থেকে জানা যায় জেলার সাঁড়া , সাঁথিয়া , সুজানগর সহ অনেক এলাকায় ইক্ষু নির্ভর শিল্প রয়েছে। জেলায় প্রচুর পরিমানে সরিষা উৎপাদিত হয় , আর এর ফলে এখানে গড়ে উঠেছে অনেক তেল কল। পূর্বে খুলু সম্প্রদায় এই পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিল, যন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা আজ বিলুপ্ত পায়। বর্তমানে পাবনা জেলা শিল্প ক্ষেত্রে একটি অনগ্রসর অঞ্চল। তবে অন্যান্য কৃষিজাত পন্য মোটামুটি উৎপাদিত হয়ে থাকে। হোসিয়ারী তাঁত শিল্পে পাবনা জেলার যথেষ্ট সুনাম আছে। ঔষধ শিল্পেও উলেনখ করার মত। বর্তমানে পাবনা জেলাতে প্রায় ৫০০ হোসিয়ারী শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। এ প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রায় ১০০০০ শ্রমিক নিয়োজিত আছে। বর্তমানে হোসিয়ারী শিল্পের মূল উপাদান গার্মেন্টস এর ঝুট। এই ঝুট বাইরে চলে যাওয়ায় এর প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে। লোড শেডিং আরেকটি প্রতিবন্ধকতা এই শিল্পের জন্য পাবনার তৈরী গেঞ্জি বর্তমানে নেপাল, ভারত, ভূটান, মালয়েশিয়া ও সিংগাপুরে ঢাকা মারফত রপ্তানী হচেছ। ঝুট রপ্তানীর চেয়ে গেঞ্জি রপ্তানী করে সরকার অনেক বেশী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে আসছে। ঝুট রপ্তানী বন্ধের দাবী ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। তারা সহজ শর্তে ঋণেরও দাবী করেছেন। তাঁত শিল্পে পাবনা জেলা সমৃদ্ধশালী। এখানকার শাড়ী, লুংগী ও গামছা বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। তাই তাঁত শিল্পের ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋন দিয়ে পাবনার তাঁত শিল্পকে আরো উজ্জীবিত করা প্রয়োজন। তাঁত শিল্প উজ্জীবিত হলে বহু কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং শাড়ী, লুংগী, গামছা বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সক্ষম। বস্ত্র শিল্পের মধ্যে পাওয়ার লুম ২৪টি, চিত্র রঞ্জন তাঁত ১৪১৮ টি, হস্তচালিত তাঁত ৩৭৮১ টি, গেঞ্জি তৈরী ৩৬৫ টি, সুতা পাকানো ২০টি, এমব্রয়ডারী ২৭টি। পাবনা জেলাতে বেশ কয়েকটি ঔষধ কোম্পানী রয়েছে। বিশেষ করে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানী উলেনখযোগ্য। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানীর ঔষধ বিদেশে রপ্তানী করে বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশ সুনাম অর্জন করেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হয়েছে। তাই পাবনার ঐতিহ্যবাহী এডরুক লিঃ ও ইউনির্ভাসেল ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানী সহ পাবনা জেলার অন্যান্য ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠানকে যদি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় আরো উন্নত করা যায় তাহলে পাবনা জেলা ঔষধ শিল্পে যথাযথ ভূমিকা রাখবে এবং এতে করে বহু কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এডরুক লিঃ এর ১৯৪৮ সনে কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মরহুম আব্দুল হামিদ খাঁন। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মরহুম আঃ হামিদ খান সাহেবের সুষ্ঠু পরিচালনায় ১৯৬৭ সন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়ে স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত হয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক্ এর মৃত্যুর পর একের পর এক নানা হাত বদলের পর এবং ১৯৮২ সালের ঔষধ নীতির কারণে এডরুকের করুন পরিনতি ঘটে। ১৯৬৭ হতে ১৯৯৯ সন পর্যন্ত নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে অনেক বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে বর্তমানে একটি সন্তোষজনক অবস্হায় এসেছে। খ) স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসস লিমিটেডঃ স্কয়ার গ্রুপের প্রথম প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। ১৯৫৮ সালে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৮ সনে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ঔষধ রপ্তানী শুরু করে। ঔষধের কাঁচামাল তৈরীর জন্য পাবনায় স্কয়ার কেমিক্যাল ডিভিশন নামে নতুন একটি ইউনিট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ৯০০১ঃ২০০৯ ISO সনদ পত্র ছাড়াও MHRA UK Certificate অর্জন করেছে যা ইউরোপীয় ঔষধ রপ্তানীর জন্য গুরুত্ববহ। এছাড়া স্কয়ার ফার্ম FDA Certificate অর্জনের পথে রয়েছে যার ফলে আমেরিকার বাজারে স্কয়ারের মোট কমীর সংখ্যা ২৫০০০। স্কয়ার পাবনা তথা সমগ্র দেশের কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গ) ইউনিভার্সাল লিমিটেডঃ ১৯৬৭ সনে ইউনিভার্সাল ল্যাবরেটরিজ প্রথম প্রতিষ্টিত হয়। ১৯৯৮ সনে মালিকানার পরিবর্তন হওয়ার পর ২০০০ সনে ইউনিভার্সল ফুড লিমিটেড এবং ইউনিভার্সল ফার্মাসিউটিক্যালস (ইউনানী) একই সাথে যাত্রা শুরু করে। এই প্রতিষ্ঠান গ্রুপের বর্তমান জনবল ১০০০। কিছু ফুড আইটেম সৌাদি আরবে এবং ইন্ডিয়ারা রপ্তানী হয়েছে বলে জানা যায়। ঘ) বেঙ্গল মিটঃ ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত গরু ও ছাগলের মাংস কিনে স্বয়ংক্রিয় প্রসেসে জবাই করে প্যাকেট করে মাংস ঢাকায় এবং বিদেশে রপ্তানী করে। প্রতি দিনের উৎপাদন ২৫০০ কেজি। বাংলাদেশে এ ধরণের প্রতিষ্ঠান একটিই। এখানে শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে, অনেক লোক গরু এবং ছাগল পালনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। ঙ) পাবনা সুগার মিলঃ ঈশ্বরদী উপজেলায় পাবনা সুগার মিল্স লিঃ নামে একটি চিনির কারখানা আছে। এখানে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আখ থেকে চিনি তৈরী হয়। পাবনা জেলাতে ক্ষুদ্র মাঝারী শিল্পের বহু উদ্যোক্তা রয়েছে। ওরিয়েনটেশন কোর্সের মাধ্যমে জনগনকে সচেতন করে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠানে আগ্রহী করে তোলা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প গড়ে উঠলে বহু কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া পাবনার ক্যালিকো কটন মিলস, ঈশ্বরদী আলহাজ্ব^ টেক্সটাইল মিলস এবং নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল সরকারী ব্যবস্থাপনায় যৌথভাবে অর্থ বিনিয়োগ করতঃ মিল তিনটি পুনরায় চালু করা গেলে বহু মানুষেযর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, দেশ এগিয়ে যাবে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে। ঈশ্বরদী ইপিজেড পুর্নাংগভাবে চালু করা দরকার। এখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে গ্যাস সহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধা রয়েছে। ঈশ্বরদী ইপিজেডে গ্যাস সহ সকল সুবিধা বিদ্যমান আছে হেতু ঈশ্বরদী ইপিজেডে এগ্রোবেইজড ইন্ডাষ্ট্রিসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ন্থাপন করা প্রয়োজন। তাছাড়াও যেহেতু উওরাঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমান কৃষিজপন্য উৎপাদিত হয়ে থাকে সেহেতু ঈশ্বরদী ইপিজেডে একটি সার কারখানা স্থাপন করা প্রয়োজন। পূর্বাঞ্চল থেকে সার আনতে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। ফলে কৃষি ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে এবং কৃষিজ পন্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বরদী বিমান বন্দরটি চালু করা একান্ত প্রয়োজন। বিমান বন্দরটি চালু করলে দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ঈশ্বরদরী ইপিজেডে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে আগ্রহী হবেন। নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপিত হলে বহু লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। পরিশেষে ঈশ্বরদী ইপিজেড ও ঈশ্বরদী বিমান বন্দরটি চালু করলে এবং হোসিয়ারী ; তাঁত ; ঔষধ ক্ষুদ্র মাঝারী ও আবাসন শিল্পসহ নানাবিধ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে ও ক্যালিকো কটন মিল এবং ঈশ্বরদী আলহাজ্ব টেক্টাইল মিল চালু করলে পাবনা জেলা শিল্পে আরো সমৃদ্ধশালী হবে। এতে করে পাবনা জেলার সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হবে। পাবনার শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ক) জেলায় বিদ্যমান শিল্পের তথ্যাদিঃ বৃহৎ শিল্পের উপখাত ভিত্তিক বিবরণ মাঝারী শিল্পে খাত ভিত্তিক বিবরণ চিনি কল ০১টি বস্ত্র কল ০২টি কাগজ কল ০১টি রসায়ন শিল্প (সিমেন্ট ফ্যাক্টরী সহ) ০৬ টি সুতা কল ০১টি খাদ্য ও খাদ্যজাত (দুগ্ধ প্রত্রিুয়াজাতকরণ) ০৩টি ঔষধ শিল্প ০৩টি প্রকৌশল শিল্প (রি-রোলিং) ০১টি কোল্ড ষ্টৌারেজ ০৩টি মোট= ০৬টি মোট = ১৫টি

খেলাধূলা ও বিনোদনে পাবনা

জেলা পাবনা প্রাক প্রাকিস্তান কাল পর্যন্ত ফুটবল খেলায় বেশ সুনামের অধিকালী ছিল। প্রতি শহর, গ্রামে, গঞ্জে, ফুটবলের প্রচলন ছিল এবং তা আজো আছে, যদিও মানগত প্রশ্নে পূর্বের মত আশাব্যঞ্জক নয়। পাবনার কতিপয় ক্লাব আজো মানুষের স্মৃতিপটে আছে। তার মধ্যে pabna Football Club, Police Team, pabna Edward College Team, Serajgang Town Club, প্রভৃতির নাম উচ্চারিত হতে শুনা যায়। ৩০ এর দশকে যখন ফুটবলের নেশা তুঙ্গে উঠেছিল, তখন ঐ সব টিমগুলো বাইরে খেলে যথেষ্ট সুনাম ও সুষশের অধিকারী হয়। তারা সেকালে বহরমপুরের হুইলার শীল্ড, জলপাইগুড়ির ‘‘সোনা’’ উল্লাশীড’’ ফরিদপুরের ‘‘রামকানাই শীল্ড’’ যা সেকালে অত্যন্ত মহার্ঘ ছিল, তা তারা জয় করে আনে। ঐ ৩০-এর দশকে পাবনাতে ফুটবল যাদুকর ‘‘সামাদ’’ এসেছিলেন খেলতে আরো এসেছিলেন গোষ্টপাল, উমাপতি, আঃ হামিদ (মোহন বাগানের) ফুটবল জগতের অমর ব্যক্তিত্ব প্রমুখ। বিখ্যাত ফুটবল টিম মোহন বাগান, এরিয়ানস্, কাষ্টমস পাবনা জ্যাকসন শীল্ডে খেলতে এসেছিল ঐ কালে। পাবনার ফুটবল আকাশে (S.N. Chawdhury) সতু সান্যাল (সতী মোঃ সান্যাল), মতু সান্যাল, বীজু শেখ, তফাজ্জল হোসেন, নীতু জোয়ারদার মাখন চাকী, বীরেন রায়, উপেন বসাক, শান্তি, পাশা, নীলু, প্রভৃতির কথা মনে করে সবাই। ইদানিংকাল (Football) এসোসিয়েশন বেশ নাম করেছিল। ১৯৬০ এর দশকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আফতাব উদ্দীন সাহেব (সিলেট)। তাঁর উৎসাহ এবং সক্রিয়তায় পাবনার ফুটবল জগতে ৬০ দশক একটি অমর যুগ ছিল। সে সময় পাবনা থেকে ফুটবল বিভিন্ন জেয়ার খেলে বহু ‘‘কাপ’’ ‘‘শীল্ড’’ ‘‘মেডেল’’ প্রভৃতি জয় করে পাবনার গৌরব বৃদ্ধি করেছিল, পাবনা হয়ে উঠে প্রাণচঞ্চল। পাবনার ফটুবল খেলা যতকাল জীবিত থাকবে, তার সাথে সাথে আফতাব উদ্দীনের নাম অমর হয়ে থাকবে। পাবনা জেলার বিশেষ উল্লেখযোগ্য খেলার মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কাবাডি, হ্যান্ডবল, দাবা, সাঁতার ও এ্যাথলেটিক্স অন্যতম। খেলাধুলার জন্য পাবনা সদরে ১টি, বেড়া ও ঈশ্বরদী উপজেলায় একটি করে মোট ৩টি, এছাড়া পাবনা সদরে আর,এম, একাডেমীতে ১টি, জি.সি.আই-এ ১টি, পাবনা জেলা স্কুলে ১টি, দোগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, পাবনা মুনছুর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, বেড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, বেড়া বি.বি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, নাকালিয়া বেড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, বোনয়ারী নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, ফরিদপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, ধুলাউড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, কাশিনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, আতাইকুলা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, দুলাই উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি সনদহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, ভাঙ্গুরা ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, পাটুলিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, উদয়ন একাডেমীতে ১টি, অষ্টমুনিষা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, সুজানগর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি নাজিরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, চিনাখড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, সাড়া মারোয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, এয়ারপোর্ট একাডেমীতে ১টি, বাঁশের বাধা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, রূপপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, বাঘাইল উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, আটঘড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, দেবোত্তর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, রামচন্দ্রপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, মূলগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি। হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, দূর্গাদাস উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, বোয়ালমারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, বিলচলন উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, ছাইকোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি, হান্ডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি সর্বমোট ৪৪টি মাঠ রয়েছে।

পাবনা জেলার ভাষা ও সংস্কৃতি

পাবনা জেলার সবাই বাঙ্গালী, তাই তাদের একই ভাষা-বাংলা। সেই বাংলা ভাষার উচ্চারণের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। গ্রামবাসী ও শহরবাসীর উচ্চারণের মধ্যে সাধারণতঃ পার্থক্য পাওয়া যায়। তার কারণ শহরের মানুষ অধিকাংশই শিক্ষিত, তাই তারা শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে এবং বলতে পারে, যা’ অধিকাংশ অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। প্রসঙ্গক্রমে গ্রামীণ ভাষার কিছু নমুনা নিম্নে উদ্ধৃত করা হ’ল। গ্রাম্য উচ্চারণ শুদ্ধ কথা গ্রাম্য উচ্চারণ শুদ্ধ কথা আঁঠ্যা উচ্ছিষ্ট ছ্যাপ থুথু উর‌্যাৎ উরুদেশ ডাঙ্গর বড় কচলান মাজা কেডা কে কনে কোথায় প্যাঁক কাদা কুত্যা কুকুর গতর শরীর শিশুর নামকরণ হিন্দু এবং মুসলমান সকলেই পুত্র কন্যার দুইটি করে নাম রাখে; একটি চলিত বা ডাক নাম, অপরটি; ভাল নাম। হিন্দুদের মধ্যে রাধাবল্লভ, পার্বতীশঙ্কর, কালিদাস প্রভৃতি এবং মুসলমানদের মধ্যে মহম্মদ, ইয়াকুব, রহিম, করিম প্রভৃতি নাম প্রচলিত ছিল। বর্তমানে শিশুদের নামকরণে আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অভিভাবকগণ শিশুর নামকরণে পাশ্চাত্য ধারাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। শোকপ্রকাশ সাধারণ লোক উচ্চস্বরে ক্রন্দন করে শোক প্রকাশ করে। ভদ্রবংশীয় হিন্দু মুসলমান স্ত্রী-পুরুষ সকলেই আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুতে ধীরে ও নীরবে শোক প্রকাশ করে। সাধারণ শ্রেণীর লোক উচ্চ রবে মৃত ব্যাক্তির গুণাবলি কীর্তন করত যে ক্রন্দন করে তা দূর হতে গীতধ্বনি বলে প্রতীয়মান হয়। আচার অনুষ্ঠান পূর্বে হিন্দু সমাজে কন্যাপণ দিতে হত। এখনও নিম্নশ্রেণীর মধ্যে এই প্রথা বর্তমান আছে। কিন্তু ভদ্র সমাজে পাত্রপণ ক্রমশই অধিক প্রচলিত হচ্ছে। ভদ্রসমাজে বরযাত্রীগণের আবদার ও উৎপাতে এবং চা, বিস্কুট, সোডা, লেমোনেড সরবরাহ করতে কন্যা কর্তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে এধরণের অত্যাচার বিশেষ পরিলক্ষিত হয় না। মুসলমান সমাজেও আতশবাজি ব্যবহার ও প্রীতি উপহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কুসংস্কার পাবনা জেলার লোকের মধ্যে নানারূপ সংস্কার পরিলক্ষিত হয়। যেমনঃ ভূতে পাওয়া বা ধরা, ব্রহ্মদৈত্য আনা ইত্যাদি। কারো কারো মধ্যে বার আসা, অন্যের উন্নতি বা ব্যাধি পীড়ায় ঈর্ষামূলে চোখ দেওয়া, রাত্রিতে দোকানদারগণের কোনও কোনও দ্রব্য যথা হলুদ, মধু, হরিতকি বিক্রয় না করার সংস্কার পরিলক্ষিত হয়। পার্বন মুসলমানের ধর্মীয় উৎসব ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী, ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আজহা, মোহররম, শব-ই-বরাত, ফাতেহা-ই-ইয়াজ-দাহম, আখেরী চাহার শোম্বা প্রভৃতি। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা, কালী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, সরস্বতী পূজা, জন্মষ্টমী প্রভৃতি। খৃষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্মদিন, গুডফ্রাইডে ইত্যাদি। দোলযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা, পু্ষ্পদোল, লক্ষ্মীপুজা, কার্তিকপুজা, বাসন্তীপুজা প্রভৃতি উপলক্ষে এই জেলার স্থানে স্থানে বিশেষ আমোদ উৎসব হয়ে থাকে। নষ্টচন্দ্রা ও হরিতালিকা দিনে বালকেরা যে কৌতুক ও আমোদ উপভোগ করে তা অনেক সময় লোকের অনিষ্টকারক হয়ে থাকে। ব্রত পূজা পাবনা জেলার ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, নবশাক এবং সাহা সম্প্রদায়ের মধ্যে অমাবস্যা ব্রত, যমপুকুর, পুণ্যপুকুর, অশোকষষ্ঠী, জামাইষষ্ঠী, চাপড়ষষ্ঠী, সাবিত্রী, রামনবমী, সম্পদনারায়ণ, জন্মাষ্টমী, মঙ্গলচন্ডী, শুভচন্ডী, কুলাইচন্ডী, সত্যনারায়ণ প্রভৃতি ব্রত পুজাদি সর্বত্র বিদ্যমান আছে। কার্তিক মাসে আকাশ প্রদীপ দেয়া এবং পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিনে গাভী ছেড়ে দেয়ার ও তাড়ানোর প্রথা বর্তমান আছে। আবাস সাধারণত পল্লীবাসী উলুখড় নির্মিত ‘বাঙ্গালা’ ‘চৌরী’ কাঁচাগৃহে বাস করে। কেনেস্তারা ও করগেট টিনের গৃহ ৩৫/৪০ বৎসর ধরে প্রচলিত আছে। ধণী লোক দালানে বাস করে। অতি পূর্বে এ দেশের মাটির কোঠা প্রচলিত ছিল। অধুনা ডেমরা কোঠার নিদর্শন আছে। কপাট জানালার ব্যবহার সর্বত্রই আছে্। গরিব লোক কপটের পরিবর্তে চাটাই নির্মিত বেড়া বা ঝাঁপ ব্যবহার করে। তবে যে সব গ্রামে বাজার বা হাট আছে, ব্যবসায়ী আছে, সেসব গ্রামে কিছু কিছু পাকা দালান আছে। কাঁচা বাসার সংখ্যা নগণ্য-প্রায় সবাই পাকা দালানে বসবাস করে। কিছু ছোট ছোট রাস্তা আছে যা পাকা তবে কংক্রীট বা পিচঢালা নয়। খাদ্য জেলার মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত, রুটি, ডাল, শাক-সবজি, মুড়ি, চিড়া ইত্যাদি। গ্রামে পান্তা ও কড়কড়া ভাতের বহুল প্রচালন আছে। এমনকি অবস্থাসম্পন্ন ঘরেও সকালে বাসী তরকারীর সঙ্গে পান্তা খাওয়া হয়। খাদ্যের প্রশ্নে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নাই, একমাত্র গরুর গোশত ব্যতীত, যা হিন্দুরা খায় না। তবে যে হিন্দুরা এককালে পেয়াজ, রসুন, মুরগী, ডিম, গরু প্রভৃতির নাম শুনলে নাক সিটকে দুরে সরে যেত, বর্তমান কালে তারা সে সব খাদ্যের বড় সমঝদার হয়ে পড়েছে। গ্রামের সঙ্গতি সম্পন্ন পরিবারে নানা ধরণের পিঠা যেমন- সরা পিঠা, পাটী সাপ্টা, ছিটা পিঠা, রুটি পিঠা, পরটা, তেল পিঠা, কুস্লী পিঠা, তাল পিঠা, তাল বড়া, সেমাই, পায়েস, হালুয়া, দুধের ক্ষীর, ভাপা পিঠা (ধুকী পিঠা) প্রভৃতি প্রস্ত্তত হয়ে থাকে। বিশেষ করে জামাই আসলে বা কোন মেহমান আসলে সে সব খাবার অবশ্যই বাড়ীতে হ‘তে হবে এবং তা’হয় প্রধানতঃ পরিবারের ইজ্জত বা Prestige এর প্রশ্নে। এমন কি বহু পরিবারে সঙ্গতি না থাকলেও দেনা করে, ঐ সব খাবার তৈরি ক‘রে মেহমান নওয়াজী দেখাতেহয়। তাই তাকে কৃষ্টির অঙ্গ বলে ধরা হয়। পরিচ্ছদ পাবনাবাসীর নির্দিষ্ট বা বিশেষ কোন পোষাক কোনদিনই ছিলনা, আজও নেই। তবে হিন্দু মুসলমানের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নে কিছুটা পার্থক্য আছে। হিন্দুরা ভাবে ধুতিই তার জাতীয় পোষাক আর তার সাথে ফতুয়া ও চাদর। পায়জামা, পাঞ্জাবী, সেরওয়ানী, লুঙ্গী, টুপি, জুতা প্রভৃতি সাধারণতঃ মুসলমানের নির্দিষ্ট পোষাক বলে প্রচলিত আছে। ইদানিং হাফহাতা হাওয়াই সার্ট, ফতুয়া, খাটো পাঞ্জাবী ইত্যাদির রেওয়াজ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পায়ে জুতা অথবা স্যান্ডেল থাকে। হিন্দুরা ধুতি ও সার্ট বা পাঞ্জাবী পরে। শিরস্রাণের ব্যবহার সচরাচর নাই। উভয় সম্প্রদায়ের মেয়েরা শাড়ী, ব্লাউজ, সেমিজ, জামা, পায়জামা, ওড়না, স্কার্ট, ম্যাক্সি ইত্যাদি পড়ে। ইদানিং কিশোরী মেয়েদের মধ্যে বোরকার পাশাপাশি ফতুয়া-জিন্স এর ব্যবহারও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। খেলাধুলা লাঠিখেলা পাবনা জেলার একটি প্রসিদ্ধ খেলা। হাটখালির লাঠিয়ালগণের বিশেষ সুনাম আছে। গারসি ও মহরম সময়ে সর্বত্রই লাঠিখেলার প্রচলন আছে। ৩০ আশ্বিন পাবনা জেলায় ‘গারসি’ বলে পরিচিত। এই দিনে সাধারণ হিন্দু মুসলমানগণের অনেকেই কুস্তি ও মল্ল ক্রীড়াদি প্রদর্শন করে থাকে। পলো নিয়ে মাছমারা এই জেলার লোকের একটি প্রাচীন আমোদ। মহিষের সিঙা বাজিয়ে লাঠি ও পলো কাঁধে নিয়ে শতাধিক লোক একত্রিত হয়ে বিল জলাশয়ে মাছ ধরে। এরা ‘‘বাহুত’’ নামে পরিচিত। নৌকাচালনে পাবনা জেলার লোক বিশেষ অভ্যস্ত। দুর্গোৎসবে পোতাজিয়া গ্রামের নৌকাবাইচ প্রথা ও পানসি নৌকার সাজ এবং সারি গানের আমোদ বহুদিন হতে প্রচলিত। এ দেশের বালকদের মধ্যে শীতকালে ঘুড়ি বা ঘুন্নি উড়ানোর প্রথা প্রচলিত আছে। এটি একটি প্রধান ক্রীড়া বা আমোদ বলে গণ্য। হাডুডু বা হৈলডুবি অনেক অঞ্চলে প্রচলিত। ডান্ডাগুলি, কঢ়িখেলা, লাটিমকাচ্চা প্রভৃতি বালকদের মধ্যে, তাস আবালবৃদ্ধবণিতা এবং পাশা, দাবা যুবক ও বৃদ্ধগণের মধ্যে দেখা যায়। কোথাও কোথাও তুরমি খেলা প্রচলিত আছে। চান্দাইকোণায় পৌষ পার্বণে চিঠি খেলার বিশেষ প্রচলন আছে। বর্তমানে স্কুল কলেজে ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস ইত্যাদি খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মীনা বাজার মোঘল আমলে বাদশাহজাদী ও তাদের সখী-সহচরী সমন্বয়ে হেরেমের মধ্যে মীনা বাজার অনুষ্ঠিত হত। বর্তমানে তা প্রদর্শনীর মত একই ধাঁচে, একই ছাঁচে চলে। যেখানে দোকান ও দর্শনযোগ্য দ্রব্যাদির দর্শন ও বিনিময় হয়ে থাকে। সেসব দোকান ও শো-রুম বা প্রদর্শনী ঘরগুলো পরিচালনা করেন মহিলারা। এখানে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। মীনা বাজারে জুয়াখেলার কথা শুনা যায়নি। তবে Variety-Show হয়। আঞ্চলিক গান পাবনা জেলা আঞ্চলিক গানে সমৃদ্ধ। এখানের মাঠে ঘাটে গ্রামান্তরে অজস্ত্র লোকসংগীত শ্রুত হয়। এগুলোর মধ্যে বরস্যা গান উল্লেখযোগ্য। যে গানে ভালবাসায় সিক্ত গ্রামের একজন বধুর অনুভুতি বর্ণনা করা হয়েছে। ওগো শুন শুন বলছি পতি যাইও না বিদ্যাশে পতি ছাইর‌্যা সতী নারী ওরে কেমনে থাইক গো বোইস্যা। আবার কোন কোন বরস্যা গান আছে যেগুলোতে কোন একটি নির্দিষ্ট মাসে প্রকৃতির অবস্থা বর্ণনা করা হয়। নিম্নের গানে বাংলা আষাঢ় মাসের কথা বলা হয়েছে। আষাঢ় মাসে আঁদলেতে বোঝাই নদী নালা পোখ পাহালী বিজ্যা মরে হারে কিন্যা দুক্কের জ্বালা। একজন বয়াতীর নেতৃত্বে আরো কিছু গায়ক কোরাস করে ধুয়া গান পরিবেশন করে। যেমন মন্রে লা-ইলাহা পড় মন্রে নেক্ পথে চল বদ্পথে হ’য়ো না খাড়া আযাব হবে বাড়া। পাবনা জেলায় আরো যে সমস্ত আঞ্চলিক গান প্রচলিত আছে সেগুলোর মধ্যে ঘুপপাড়ানী গান, বিয়ের গান, ঘুম ভাঙ্গানো গান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর তালিকা ক্র নং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর নাম ঠিকানা মোবাইল ০১. বাংলাদেশ মানবাধিকার নাট্য পরিষদ এল এম বি মার্কেট (২য় তলা), পাবনা ০১৭১১-১৮১৭৭৩ ০২. বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী কালাচাঁদপাড়া, পাবনা ০১৭১২-৩৪৪১৮৭ ০৩. পাবনা থিয়েটার’৭৭ এ আর কর্ণার (৩য় তলা), পাবনা ০১৭১১-২৩৮৫১৬ ০৪. পাবনা ড্রামা সার্কেল সেঞ্চুরী প্লাজার পেছনে, পাবনা ০১৭১১-২৩০১৯৮ ০৫. বাঙলাদেশ লেখক শিবির ৯-১০, এ আর কর্ণার, পাবনা ০১১৯৯-৪৬৮৯৯৭ ০৬. এ্যাটিউন ব্যান্ড সিকো মাইক সার্ভিস,রাধানগর, পাবনা ০১৭১১-৮০২৬৯২ ০৭. বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা এ আর কর্ণার (৩য় তলা), পাবনা ০১৭১৬-৬৯৬৩০৩ ০৮. ঝংকার শিল্পী গোষ্ঠি বাবলাতলা, পাবনা ০১৭১২-১১৫২২৮ ০৯. পথ সাহিত্য সংসদ এবিসি কম্পিউটার্স খেয়াঘাট রোড ০১৭১৭-৭৯৬২২৪ ১০. বাংলাদেশ কবিতা ক্লাব পাবনা কলেজ, পাবনা ০১৭১৭-৭০২৩৩৭ ১১. অনুশীলন আশি রাইফেলস্ ক্লাব, পাবনা ০১৭১২-১৩৭৯১০ ১২. গণমঞ্চ নাট্য সম্প্রদায় রূপকথা রোড (গণেশ লন্ড্রী), পাবনা ০১৭১১-৫৭৩৪০০ ১৩. রং বেরং শিল্পী গোষ্ঠী আনোয়ারা ক্লিনিকের গলি,শালগাড়িয়া ০১৭২৭-৯২৬৩৫২ ১৪. চিকনাই থিয়েটার মূলগ্রাম, চাটমোহর, পাবনা ০১৭২৪-৩২৪৭৯৫ ১৫. মৌচাক শিল্পী গোষ্ঠী ডাকবাংলা মোড়, পাবনা ০১৭১১-৪৬৫২১৮ ১৬. গোপালপুর ক্লাব গোপালপুর, পাবনা ০১৭১১-৪৫০৮০১ ১৭. গন্তব্য ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠন কৃষ্ণপুর, পাবনা ০১৭১৬-৬০৪০৪৬ ১৮. দর্পণ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী পাবনা কলেজ, পাবনা ০১৭১৫-২৩৪৪৭২

পাবনা জেলার খনিজ সম্পদ

ভূ-পৃষ্ঠে কিংবা ভূগর্ভের কোন স্থানে সঞ্চিত খনিজ সম্পদের অবস্থান মুলত সংশ্লিষ্ট স্থানের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে থাকে। ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভূতাত্ত্বিক পরিবেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ বিদ্যমান থাকে। সেই অর্থে পাবনা জেলা খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ নয়। পিট এখানে চলনবিল এলাকার কিছু অংশে পিট পাওয়া যায়। সারা বাংলাদেশে যেখানে পিটের মোট মজুতের পরিমাণ ১৭ কোটি টনের বেশী সেখানে শুধু চলনবিলেই মজুতের পরিমান প্রায় ৬.২ কোটি টন। চলনবিলের মজুতের গভীরতা ০.৫ - ৪.৭৫ মিটার, পুরুত্ব ৩.৩৫ - ৭.৬৫ মিটার, কার্বন ১৪.৮০%, ভস্ম ৪৬.১৩%, আর্দ্রতা ৮.৫৩%, উদ্বায়ী বস্ত্ত ৫৪.১৩%। তবে এই মজুত থেকে পিট উত্তোলন এখনও শুরু হয়নি। গার্হস্থ্য কাজে, ইটের ভাটায় এবং বয়লারের জ্বালানী হিসাবে পিট ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে বিকল্প জ্বালানী হিসাবে পিটের সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বল। পাবনা জেলার বিভিন্ন নদীর তলদেশে নির্মাণ কাজের বালি পাওয়া যায়। প্রধানত মাঝারী থেকে মোটা দানাদার কোয়ার্টজ সমন্বয়ে এই বালি গঠিত। দালান, সেতু, রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণে এই বালি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পরিকল্পিত উপায়ে এই বালি উত্তোলিত হলে বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্পে এর গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে ।

পাবনা জেলার পটভূমি


পাবনা বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী জনপদ। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবস্থানগত কারণে এ জেলা কৃষি, শিল্প, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে দ্রুত উন্নতিলাভের এক অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে এর রয়েছে এক গৌরবময় অতীত ইতিহাস। অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড় আর জলাশয় বেস্টিত পাবনা। বর্তমান পাবনা জেলা রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ পূর্বাংশে ২৩০ ৪৮’ ও ২০ ২১‌’ উত্তর অক্ষরেখা এবং ৮৯০ ও ৮৯০ ৪৪’ পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত। এ জেলার উত্তরে নাটোর ও সিরাজগঞ্জ , পূর্বে সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ, দক্ষিণে কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী এবং পশ্চিমে কুষ্টিয়া ও নাটোর জেলা অবস্থিত। জেলার জলবায়ু কিছুটা চরমভাবাপন্ন।


‘পাবনা’ নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। এক কিংবদন্তি মতে গঙ্গার ‘পাবনী’ নামক পূর্বগামিনী ধারা হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। অপর একটি সূত্রে জানা যায় ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’ নামের একজন দস্যুর আড্ডাস্থলই এক সময় পাবনা নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘পাবনা’ নাম এসেছে ‘পদুম্বা’ থেকে। কালক্রমে পদুম্বাই স্বরসঙ্গতি রক্ষা করতে গিয়ে বা শব্দগত অন্য ব্যুৎপত্তি হয়ে পাবনা হয়েছে। ‘পদুম্বা’ জনপদের প্রথম সাক্ষাৎ মিলে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে পাল নৃপতি রামপালের শাসনকালে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রামপাল হ্নতরাজ্য বরেন্দ্র কৈবর্ত শাসকদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে চৌদ্দজন সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন -এঁদেরই একজন ছিলেন পদুম্বার সোম নামক জনৈক সামন্ত। আবার অনেকের মতে পৌন্ড্রবর্ধন হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। তাঁরা বলেন পৌন্ড্রবর্ধনের বহু জনপদ গঙ্গার উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল। চলতি ভাষায় পুন্ড্রুবর্ধন বা পৌন্ড্রবর্ধন পোনবর্ধন বা পোবাবর্ধন রূপে উচ্চারিত হতে হতে পাবনা হয়েছে। ‘পাবনা’ নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। এক কিংবদন্তি মতে গঙ্গার ‘পাবনী’ নামক পূর্বগামিনী ধারা হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। অপর একটি সূত্রে জানা যায় ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’ নামের একজন দস্যুর আড্ডাস্থলই এক সময় পাবনা নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘পাবনা’ নাম এসেছে ‘পদুম্বা’ থেকে। কালক্রমে পদুম্বাই স্বরসঙ্গতি রক্ষা করতে গিয়ে বা শব্দগত অন্য ব্যুৎপত্তি হয়ে পাবনা হয়েছে। ‘পদুম্বা’ জনপদের প্রথম সাক্ষাৎ মিলে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে পাল নৃপতি রামপালের শাসনকালে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রামপাল হ্নতরাজ্য বরেন্দ্র কৈবর্ত শাসকদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে চৌদ্দজন সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন -এঁদেরই একজন ছিলেন পদুম্বার সোম নামক জনৈক সামন্ত। আবার অনেকের মতে পৌন্ড্রবর্ধন হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। তাঁরা বলেন পৌন্ড্রবর্ধনের বহু জনপদ গঙ্গার উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল। চলতি ভাষায় পুন্ড্রুবর্ধন বা পৌন্ড্রবর্ধন পোনবর্ধন বা পোবাবর্ধন রূপে উচ্চারিত হতে হতে পাবনা হয়েছে। সাবেক পাবনা (সিরাজগঞ্জ জেলাসহ) জেলা রূপে গঠিত এলাকাটি প্রাচীন যুগে পূর্ব ভারতের বঙ্গ ও পুন্ড্রুবর্ধন জনপদের অংশ ছিল। গঙ্গারিডির রাজত্বের অবসানের পর বৃহত্তর পাবনা মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। রাজা অশোক পুন্ডুসহ সমগ্র বাঙলা নিজ শাসনাধীনে এনেছিলেন। জেলাটির প্রায় সম্পূর্ণই মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। মৌর্য বংশের পতনের পর পাবনা জেলাসহ বাংলার এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অবস্থার ইতিহাস অজ্ঞতার অন্ধকারে চাপা পড়ে যায়। এ অঞ্চল সমুদ্রগুপ্তের সময়ে (৩৪০-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ) গুপ্ত সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং প্রথম কুমার গুপ্তের (৪১৩-৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে পাবনা (সিরাজগঞ্জসহ) জেলা উত্তর বাংলার পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তি নামে গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগে পরিণত হয়েছিল। গুপ্ত রাজাদের পতনের পর এই অঞ্চল খুব সম্ভবতঃ পরবর্তী গুপ্তদের অধীনে মহাসেন গুপ্তের রাজত্বকাল পর্যন্ত শাসিত হয়েছিল। তিনি ৬ষ্ঠ শতকের শেষের দিকে বাংলার এ অংশে রাজত্ব করেছিলেন। সপ্তম শতকের প্রারম্ভে শশাংক পরবর্তী গুপ্তদের উচ্ছেদ সাধনে সাফল্য অর্জন করেন। তিনি উত্তর ও পশ্চিম বাংলা এবং মগধ নিয়ে গৌড় রাজ্য নামেএকটি স্বাধীন শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেন। ৬৩৭ খ্রিঃ শশাংকের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন এই অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন। এ সময়ে ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে চীন দেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশ পরিভ্রমণে আসেন। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রাচীন বাংলার এ অংশের প্রায় দেড়শত বছরের ইতিহাস অজানার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। এ সময়ে (৬০০-৭৫০ খ্রিঃ) বাংলায় রাজনৈতিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। কেন্দ্রে কোন শাসন ছিলনা। এক চরম অরাজক অবস্থা। ইতিহাসে এ সময়কে মাৎস্যন্যায় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অষ্টম শতকের প্রারম্ভে ৭২৩ এবং ৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে কনৌজের যশোবর্ধন গৌড়রাজকে পরাজিত করে বাংলাদেশ দখল করেন এবং পাবনা জেলাসহ প্রায় সমগ্র বাংলা তাঁর হস্তগত হয়। ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যলোবর্ধনকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের উর প্রভুত্ব বিস্তার করে। পরবর্তীকালে পাবনা পালদের অধীনে এসে যায়। পাল বংশের (আনুমানিক ৭৫৮-১১৬২ খ্রিঃ) অন্তত ১৭ জন রাজা তাদের স্ব-স্ব রাজত্বকালে পাবনার উপর কর্তৃত্ব করে গিয়েছিলেন। রাম পালের মৃত্যুর পর (১১২৫ খ্রিঃ) পাল রাজবংশের অস্তিত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা পর্যায়ে সেন বংশের রাজাগণ এ অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। পালদের পতনের যুগে চালুক্য যুবরাজ ৬ষ্ঠ বিক্রমাদিত্য যখন বাংলা আক্রমন করেন সম্ভবত তখন সেনরা দক্ষিণ ভারত থেকে তার সংগে এখানে আগমন করেন। প্রথমে তারা পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করেন। অতঃপর রামপালের রাজত্বকালে উত্তর বাংলায় স্বাধীন রাজত্বের সূচনা করেন। সেন বংশের প্রথম প্রসিদ্ধ রাজা বিজয় সেন শেষ পাল রাজা মদন পালকে পরাজিত করেন। তাঁর রাজত্বকালে পাবনা অধিকারে আসে। তিনি রামপুর গোয়ালিয়া থেকে ৫ মাইল পশ্চিমে গোদাগাড়ীর সন্নিকটে বিজয় নগরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। লক্ষণ সেনের(সেন রাজবংশের শেষ রাজা) রাজত্বের শেষ ভাগে সেন রাজ্যের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দেয়। এই সময় ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমন করেন এবং লক্ষণাবতী অধিকার করে নেন। ঐ সময় পাবনা জেলা মুসলমানদের অধিকারে আসে। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে তার নব বিজিত রাজ্য শাসন করেন। ১২০৫ সাল হতে পাবনা জেলা গৌড়ের মুসলিম শাসকদের অধিকারে ছিল। ১২০৬ সালে মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর মৃত্যুর পর মুহম্মদ সিরাণ খলজি এ অঞ্চলের কর্তৃত্ব লাভ করেন। সুলতান আলাউদ্দিন উপাধি ধারণপূর্বক তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। অতঃপর দিল্লীর সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের নিকট থেকে আলী মর্দান লক্ষণাবতীর রাজ প্রতিনিধিত্ব লাভ করেন। ১২১০ সালে কুতুব উদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর আলী মর্দান দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষনা করেন এবং সুলতান উপাধি ধারণ করেন। প্রায় তিন বৎসর কাল তিনি এ জেলার উপর তার শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। তিনি খলজি আমীরগণের হাতে ১২১২ সালে নিহত হন। এই আমীরগণ অতঃপর লাখনৌতির শাসনকর্তা হিসেবে গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজীকে মনোনীত করেন। তিনি সুলতান উপাধি ধারণপূর্বক প্রায় ১৪ বৎসর রাজ্য শাসন করেন। অতঃপর ১২২৭ সালে সুলতান ইলতুতমিশের পুত্র যুবরাজ নাসির উদ্দিনের হাতে সুলতান গিয়াস উদ্দিন নিহত হলে যুবরাজ নাসির উদ্দিন লাখনৌতির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২২৭-১২৮২ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ জন শাসনকর্তা লাখনৌতির শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ঐ সময়ে লক্ষণাবতীর কোন শাসনকর্তাই দিল্লীর সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করেননি। সুলতান মুগিস উদ্দিন তুঘরিল ১৬ জন শাসনকর্তাদের মধ্যে শেষ ব্যক্তি ছিলেন। তখন দিল্লীর সুলতান ছিলেন গিয়াস উদ্দিন বলবন। তিনি লক্ষ্মণাবতীর শাসনকর্তার আনুগত্য বরদাস্ত করতে পারেননি। তাঁকে দমন করার জন্য তিনি বাংলা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে ১২৮২ সালে তুঘরিল পরাজিত ও নিহত হলে সুলতান বলবন তদীয় পুত্র বোগরা খানকে লাখনৌতির শাসনকর্তা নিয়োজিত করেন। পরবর্তী সময়ে বোগরা খাঁন দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সুলতান নাছির উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করেন। ১৩২৪ সাল পর্যন্ত লাখনৌতির স্বাধনীতা অক্ষুন্ন থাকে। ঐ বৎসর দিল্লীর সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক লাখনৌতিকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে নেন। দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলকের (১৩২৫-১৩৫১ সাল) রাজত্বের পতনোত্তর সময়ে জনৈক হাজী ইলিয়াস শাহ লাখনৌতির সিংহাসনে আরোহন করেন। নিঃসন্দেহে পাবনা জেলা হাজী ইলিয়াস শাহের (১৩৪২-১৩৫৭) রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তদীয় উত্তরাধীকারী সিকান্দার শাহ, সায়ফুদ্দিন হামজা শাহ, শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ, আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ প্রভৃতি নরপতিগণ এ জেলার উপর তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। অতঃপর রাজা গণেশ ১৪১৪ সালে লাখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন। শীঘ্রই তাঁর মৃত্যু ঘটায় রাজত্বকাল স্বল্পস্থায়ী হয়। অতঃপর তদীয় উত্তরাধিকারী ও পুত্র যদু ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন ও জালাল উদ্দিন নাম গ্রহণ করেন। জালাল উদ্দিন ১৪৩২ সাল পর্যন্ত এই জেলার উপর তাঁর শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। তারপর তদীয় পুত্র সামছুদ্দিন আহমদ শাহ ১৪৪২ সাল পর্যন্ত এই এলাকা শাসন করেন। উক্ত সামছুদ্দিন আহমদ শাহকে হত্যা করে জনৈক নাসির উদ্দিন আবুল মোজাফফর মাহমুদের মাধ্যমে ইলিয়াসশাহী রাজ বংশ পুনঃ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত এ জেলা উক্ত ইলিয়াসশাহী রাজবংশের শাসনাধীনে ছিল। অতঃপর ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের প্রশাসন ব্যবস্থায় বিভ্রান্তি ও বিশৃংখলা বিরাজ করছিল। এ সময়ে আবিসিনীয় অধিবাসীরা ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মাধ্যমে ইলিয়াসশাহী রাজবংশকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে। এদের শেষ রাজা সামছুদ্দিন মোজাফফর শাহ (১৪৯১-১৪৯৩) তদীয় উজির সাঈদ হোসেন কর্তৃক নিহত হলে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উপাধি ধারণ করে ১৪৯৩ সালে তিনি লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই এ জেলা আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনাধীনে ছিল। তাঁর উত্তরাধিকারীগণ ১৫৩৮ সাল পর্যাপ্ত এই জেলার উপরে তাদের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে এ অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসে এবং দেশে সুশাসন কায়েম হয়। এ সময়ে রাজনৈতিক সম্প্রীতি বিস্তৃতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সমৃদ্ধির ঘটে। অতঃপর দিল্লীর সুলতান শের শাহ শুরী(১৫৩৯-১৫৪৫ সাল) কর্তৃক বাংলা বিজয়ের ফলে ১৫৩৮ সালে হোসেন শাহী রাজবংশের রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। অতঃপর শেরশাহের মৃত্যুর পর ইসলাম শাহ(১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিঃ) এ জেলার উপর তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর বাংলার শাসনকর্তা শুর বংশীয় মাহমুদ খান শুর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সামছুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ গাজী (১৫৫৩-১৫৫৬ সাল) উপাধি ধারণ করে পাবনা জেলায় তাঁর শাসন ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র গিয়াসুদ্দিন বাহাদুরশাহসহ তদীয় উত্তরাধীকারগণ ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত এ জেলার উপর তাদের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে তাজ খান কররানী লাখনৌতির সিংহাসন দখল করলে পাবনা জেলা তার শাসনাধীনে চলে যায়। এভাবে ১৫৭৪ সাল পর্যন্ত দাউদ কররানী এ জেলার কর্তৃত্ব করেন। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে মুঘল সেনাপতি মুনিম খানের নিকট পরাজিত ও নিহত হন এবং ১৫৭৬ সালে লাখনৌতি বা গৌড়রাজ্যে মুঘল শাসনের সূচনা ঘটে। পাবনা জেলা এ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত থাকায় তা ঐ একই বছর মুঘল শাসনাধীনে এসে যায়। ১৫৭৬-১৭২৭ সাল পর্যন্ত দিল্লীর মুঘল সম্রাজ্যের অধীনে ২৯ জন শাসনকর্তা এ জেলার উপর তদের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি সম্পন্ন ছিলেন রাজা মানসিংহ, ইসলাম খাঁ, শাহজাদা মুহম্মদ সুজান, মীর জুমলা, নবাব সায়েস্তা খাঁ, নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ। সুদীর্ঘ মুঘল শাসনাধীন সময়ে পাবনা জেলায় শান্তি ও প্রগতির এক নুতন যুগের সূচনা হয়। নবাব মুর্শিদকুলী খানের (১৭০০-১৭২৭ সাল) অধীনে কার্যতঃ বাংলা স্বাধীন হয়। তিনি কঠোর রাজস্বনীতি অবলম্বন করেন। এর ফলে পূর্ববর্তী আমলের জমিদারগণ রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের জমিদারী কেড়ে নিয়ে নবাবের অনুগ্রহ ভাজনদের মধ্যে বিলি করা হয়। এভাবে উত্তরাধীকারী সূত্রে রাজা হওয়ার পরিবর্তে নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয় এবং বাসতবিক পক্ষে সমসত বাংলার মধ্যে এই জেলার রাজাদের প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন নাটোর রাজ। নাটোর রাজার পরিবারের সদস্যগণ বরেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণদের মৈত্র পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত পদ্ধতিতে নবাব মুর্শিদকুলী খানের দেওয়ান থাকা অবস্থায় ১৭০৭ সাল থেকে এ সকল জমিদারি নাটোর রাজের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাম জীবনকে প্রদান করা হয় এবং তিনি ১৭৩০ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনা করেন। এতে পাবনা জেলা অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৭২৭-১৭৩৯ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা তৎকালীন সুবেদার নবাব সুজা উদ্দিনের শাসনাধীনে ছিল এবং রাজশাহীর জমিদারির রাজস্ব শাসন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন রাম জীবন। ১৭৩০ সালের পর রাম জীবনের উত্তরাধিকারী মহারাজ রামকান্তের উপর রাজস্ব শাসন ব্যবস্থা অর্পিত হয়। আলীবর্দী খাঁ ১৭৪২-১৭৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন। মহারাজ রামকান্তের মৃত্যুর পর এ বিশাল জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব রানী ভবানীর উপর এসে পড়ে। এই প্রতিভাময়ী মহিলা পলাশী, উদয় নালা, বকসার যুদ্ধ এবং লর্ড ক্লাইভের দ্বৈত শাসন ও অষ্টাদশ শতকের বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোকক্ষয়কারী মহাদুর্ভিক্ষের অরাজকতা পূর্ণ সময়ে দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী কালব্যাপী দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে এই বিশাল জমিদারির শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। আলীবর্দী খাঁর শাসনামলে পাবনা জেলা মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ১৭৫৬ সালে আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তদীয় দৌহিত্র উত্তরাধিকারী নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা বাংলা সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং এক বছরকাল পাবনা জেলাসহ সমগ্র বাংলার শাসন ক্ষমতা বজায় রাখেন। ১৭৫৭ সাথে তাঁর রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং এই সংগে শেষ হয় বাংলার স্বাধীন মুসলিম রাজত্ব। ১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে বাংলায় তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে বক্সারের যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার দেওয়ানী লাভ করে। অথচ রাজশাহীর জমিদারির রাজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থায় কোনরূপ হসতক্ষেপ করা হয়নি। পাবনা জেলা প্রধানতঃ রাজশাহীর জমিদারির অন্তর্ভূক্ত থাকায় একমাত্র রানী ভবানীই কোম্পানীকে এর ভূমি রাজস্ব প্রদানের জন্য দায়ী ছিলেন। জেলার একাংশ অবশ্য বড়বাজু ও কাগমারী জমিদারির অন্তর্ভূক্ত ছিল যা বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। সিরাজগঞ্জ জেলার বৃহত্তর অংশ নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে (১৭০৩-১৭২৬ সাল) বড়বাজু ও কাগমারী জমিদারির অংশ ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিট্রিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক ও কারিকরদের বিদ্রোহ ঘটে। সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ ‘‘ফকির ও সন্নাসী’’ বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলার ফকির সম্প্রদায়ের দলপতি শাহ মস্তান বোরহানা উত্তর বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিট্রিশ বিরোধী কাজে তৎপর ছিলেন। এ সময় সিরাজগঞ্জের নিকটে ফকিররা খুবই তৎপর ছিল। মজনু শাহ ১৭৮৭ সালে তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত পাবনা ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহে (রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ) তৎপর ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় জেলার বেশিরভাগ অংশ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। বাংলার এই অংশে প্রধানতঃ বহু সংখ্যক ডাকাত দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকায় ১৮২৮ সালে এটিকে একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসাবে গঠন করা হয়। আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং অধিবাসীদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পাবনায় সাময়িকভাবে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয় ১৮২৮ সালে। ১৮৩২ সালে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়োগ স্থায়ী করা হয় এবং এই সময় তাঁকে একজন স্বতন্ত্র ডেপুটি কালেক্টর রূপে নিযুক্তি প্রদান করা হয়। স্বতন্ত্র জেলা সৃষ্টির প্রাক্কালে রাজশাহীর পাঁচটি থানা আলাদা করে জেলাটি গঠিত হয়। এসব থানা ছিল রাজশাহী থেকে ক্ষেতপাড়া, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুর, মত্থরা ও পাবনা এবং যশোরের ৪ টি থানা। ১৮৪৮ সালে জেলার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত হিসাবে যমুনা নদীকে স্থির করা হয় এবং এ নদীর গতি ধারায় পরিবর্তনের দরুন ১৮৫৫ সালে সিরাজগঞ্জ থানাটি ময়মনসিংহ থেকে নিয়ে পাবনার সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৮৫৯ সালে একজন ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর রাখার বর্তমান পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং একই সময়ে এতকাল যাবত পাবনার অংশ হিসেবে পরিগণিত পাংশা, খোক্সা ও বালিয়াকান্দি এই তিনটি থানা নিয়ে স্বতন্ত্র ‘‘কমরকলি’’ (কুষ্টিয়া কুমারখালী) মহকুমা গঠন করা হয়। পদ্মার দক্ষিণে এক বিরাট ভূখন্ড তখনও এ জেলার অধীন ছিল। ১৮৬০ সালে কুষ্টিয়া মহকুমা নদীয়ার সংগে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৭১ সালে পাবনা থেকে পাংশা থানা ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমার এবং কুমারখালী থানা নদীয়ার কুস্টিয়া মহকুমার সাথে সংযুক্ত করা হয়। এভাবে জেলার দক্ষিণ সীমানা পদ্মা নির্ধারিত হয়। ঊনিশ শতাব্দির ফরায়েজী ও তারিকৎ-ই-মুহাম্মদীয়া আন্দোলন দুটির দ্বারা পাবনা জেলার অধিবাসীগণ ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত হয়। ১৮১৮ সালে ফরায়েজী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তারিকৎ-ই-মুহাম্মদী আন্দোলন সৈয়দ আহমেদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ কর্তৃক সূচিত হয় ১৮১৮ সালে। ১৮২০ সালে সৈয়দ আহমেদ শহীদ কলকাতা সফর করেন এবং অসংখ্য লোক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে তারিকৎ-ই-মুহাম্মদীয়া আন্দোলনের প্রভাব পাবনা জেলাসহ বাংলার অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫৭ সালে ভারত বর্ষের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে(ইংরেজের চোখে সিপাহী বিদ্রোহ) এই জেলা নীরব ছিল। এই জেলার মধ্য দিয়ে ঢাকার বিদ্রোহীদের উত্তর বাংলায় গমন পথে বাধা সৃষ্টি করার জন্য পাবনা জেলার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ রেভেন্স জেলার নীলকর সাহেবগণকে সৈন্যদল গঠন করতে নির্দেশ দেন। এই বিদ্রোহের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের অবসান ঘটে তখন স্বভাবতঃই পাবনা জেলা ১৮৫৮ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসনাধীনে চলে যায়। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সমগ্র পাবনা জেলাব্যাপী নীলের চাষ ও নীল তৈরীর কাজ ব্যাপকভাবে চালানো হয়। নীলচাষ চাষিদের নিকট কখনো জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। কেননা জমিদারগণ এর বিরুদ্ধে ছিলেন এবং নীলের জমির উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে রায়তদের লাভ করার আশা নির্মূল করে দিতেন। এই জেলার নীলকরদের পীড়ন নীতির ফলে কৃষকরা ১৮৫৯-৬০ সালে বিদ্রোহ করে। ফলে নীলের চাষ ও নীল তৈরীর কাজ নীল চাষিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। নীল বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনয়ন করে। দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য জেলায় জেলায় কালেক্টরের পদ সৃষ্টি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। মিঃ জি ব্রাইট এই জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর নিযুক্ত হন। ১৮৭২-৭৩ সালে পাবনা জেলায় ভূ-সম্পত্তি সংক্রান্ত গোলযোগ দেখা দেয় এবং তা কৃষক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৫ সালে বেংগল টেনান্সি এ্যাক্ট জারির মাধ্যমে সমগ্র বাংলাসহ এই জেলায় কৃষক আন্দোলন স্তিমিত হয়। লর্ড কার্জনের শাসনামলে (১৮৯৯-১৯০৫ সাল) বঙ্গ ভঙ্গের ফলে পাবনা জেলা নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা ও আসামের সংগে যুক্ত হয়। অবশ্য ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গ ভঙ্গ রদ হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট তারিখে পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটায় এই জেলা (সিরাজগঞ্জসহ) পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জনগণের মনে পাকিস্তানের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শাসক সম্প্রদায়ের বৈষম্য ও শোষণমূলক নীতি ও আচরণের ফলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। তাছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ পুর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে সমস্ত পাকিস্তানের জন্য একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার ফলে পুর্ব বাংলার তরুণ, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবি সমাজ পাকিস্তান সরকারের এই একতরফা ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাডাঁয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবী আদায়ের জন্য বাঙালিরা স্বাধীকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালির এ ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় এক দীপ্ত ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে আন্দোলনের একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকে পাবনাবাসীও একাত্ব হয়ে যায়,। পাবনার জেলা ও থানায় থানায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২৩ মার্চ পাবনার টাউন হলে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। পরপরই পতাকা উত্তোলিত হয় জেলা প্রশাসকের বাসভবনে। জেলা প্রশাসক জনাব এম নূরুল কাদের খান মুক্তিকামী জনতার জন্য পুলিশ লাইনের অন্ত্র ভান্ডার খুলে দিয়ে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হবার আহবান জানান। ২৬ মার্চ রাতে পাক সেনারা বিসিক শিল্পনগরীতে ঘাটি করে এবং টেলিগ্রাফ অফিস, সার্কিট হাউজ, স্টেডিয়াম, ডাকবাংলো দখলে নেয়। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় পাকসেনারা পুলিশ লাইন আক্রমন করে। ব্যারাকের পুলিশ সদস্যরা গড়ে তোলে প্রতিরোধ। তাদের সাথে যোগ দেয় জেল পুলিশ। শহরের মুক্তিকামী জনতার সাথে প্রতিরোধে অংশ নেয় চরাঞ্চল এবং গ্রাম অঞ্চল থেকে আশা হাজার হাজার মানুষ। টেলিগ্রাফ অফিসসহ বিভিন্ন স্থানের প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ২৮ মার্চ পাকসেনারা পালিয়ে যায় রাজশাহীতে। ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা ছিল স্বাধীন। বাংলাদেশের মানচিত্রে সম্মুখ সমরে প্রথম শত্র্রু অবমুক্ত জনপদ হওয়ার দূর্লভ গৌরব অর্জন করে পাবনা। ৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে কোর্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশর পতাকা উত্তোলিত হয়। ১১ এপ্রিলে পাকসেনারা আবার চলে আসে পাবনাতে। জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ হয়, অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তথ্য প্রবাহের সুযোগ না থাকায় এবং ১৭ তারিখ পর্যন্ত পাকসেনারা দখলরত থাকায় পাবনা শত্রুমুক্ত হয় ১৮ মার্চ।

এক নজরে পাবনা জেলা
  সাধারণ তথ্যাবলী আয়তনঃ ২,৩৭১.৫০ বর্গ কিঃ মিঃ লোকসংখ্যাঃ ২২,৬০,৫৪০ (ক) পুরুষ (খ) মহিলাঃঃ ১১,৫৬,৮০৯ ১১,০৩,৭৩১ খানার সংখ্যাঃ ৪,৪২,০৪৯ টি উপজেলার সংখ্যাঃ ৯ টি থানার সংখ্যাঃ ১০ টি পৌরসভার সংখ্যাঃ ৯ টি (আটঘরিয়া পৌরসভা-নবগঠিত) ইউনিয়নের সংখ্যাঃ ৭৩ টি গ্রামের সংখ্যাঃ ১,৫৪৯ টি মৌজার সংখ্যাঃ ১,৩২১ টি ডাকঘরঃ ১৪৫ টি টেলিফোন অফিসঃ ৯ টি ডাকবাংলো ও রেষ্ট হাউজঃ ১৬ টি সরকারী শিশু সদনঃ ১ টি স্টেডিয়ামঃ ৩ টি পাবলিক লাইব্রেরীঃ ৩ টি মসজিদঃ ২,১১২ টি মন্দিরঃ ৩৪৫ টি গীর্জাঃ ৯ টি সেবা আশ্রমঃ ২ টি নদী বন্দরঃ ৩ টি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধঃ ১ টি আধুনিক সুইমিং পুলঃ ১ টি বিমান বন্দরঃ ১ টি (বর্তমানে চালু নেই ) দৈনিক পত্রিকাঃ ৭ টি সাপ্তাহিক পত্রিকাঃ ৬ টি এন,জি,ও শাখাঃ ৫১ উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানঃ লালন শাহ্ সেতু, হার্ডিঞ্জ ব্রীজ, মানসিক হাসপাতাল, জোড় বাংলো, আজিম চৌধুরীর জমিদার বাড়ী (দুলাই), শাহী মসজিদ (ভাড়ারা), শ্রী শ্রী অনুকৃল চন্দ্র ঠাকুরের আশ্রম, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস্, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, পাবনা সুগার মিল্স, ঈশ্বরদী বিমান বন্দর, কৃষি ফার্ম, নগরবাড়ী/ নটাখোলা ঘাট, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল। রাজস্ব বিষয়ক উপজেলা ভূমি অফিসঃ ৯ টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসঃ ৫৮ টি পৌর ভূমি অফিসঃ ৮ টি খাস জমির পরিমাণঃ ৬,৯২৬.৯৬১১ একর ক) কৃষিঃ ৬,৮৪৭.৮৬১১ একর খ) অকৃষিঃ ৭৯.১০ একর জলমহালঃ ১১৮ টি আদর্শ গ্রাম ( প্রকল্প-১)ঃ ২৩ টি ( প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়িত ) উপকার ভোগী পরিবারঃ ৮১১ আদর্শ গ্রাম (প্রকল্প-২) প্রেরিত প্রস্তাবঃ ৭ টি অনুমোদিতঃ ৭ টি জমির পরিমাণঃ ১৬৬.৮৫ একর আশ্রয়ন ঃ ১০ টি ; পরিবার- ৫৭০ টি আবাসনঃ ৩ টি ; পরিবার- ৫০ টি + ৩০টি =৮০ টি। মৌজাঃ ১,৩২১ টি শিক্ষা বিষয়ক প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ ১,০৮৬ টি ক) সরকারীঃ ৬৬৪ টি খ) বেসরকারীঃ ৪২২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ ২০২ টি ক) সরকারীঃ ৩ টি খ) বেসরকারীঃ ১৯৯ টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ ৪৯ টি মাদ্রাসাঃ ১২৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজঃ ১ টি মহাবিদ্যালয়ঃ ৪৮ টি ক) সরকারীঃ ৪ টি খ) বেসরকারীঃ ৪৪ টি মেডিক্যাল কলেজঃ ১ টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ঃ ১ টি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ ৩ টি ক্যাডেট কলেজঃ ১ টি পলিটেকনিক ইনষ্টিটিটঃ ১ টি ভোকেশনাল ইনষ্টিটিউটঃ ১ টি কমার্শিয়াল ইনষ্টিটিউটঃ ১ টি আইন কলেজঃ ১ টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষক ইনষ্টিটিউটঃ ১ টি টেক্সটাইল ইনষ্টিটিউটঃ ১ টি সেবিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রঃ ১ টি হোমিওপ্যাথিক কলেজঃ ১ টি মক্তব/ ফোরকানিয়া মাদ্রাসাঃ ২৬৪ টি  

পাবনার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব
ঐতিহ্যে সমৃদ্ধময় নদীমাতৃক জেলা পাবনা। এর মাটির গন্ধ, শ্যামল প্রকৃতি মনে রেখাঙ্কন করে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এ জেলার অবদান নগন্য নয়। কালের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে আবির্ভাব ঘটেছে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের। এই সব শিল্পীর অনবদ্য অবদানে আমাদের সাহিত্য হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী পাবনা জেলার যে সব শিল্পী-সাহিতিাকের নাম এতে আলোচিত হয়েছে, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের বিশেষ ভুমিকা লক্ষ্যণীয়। প্রথমে কবিতা প্রসংগে আলোচনা করা যেতে পারে। মধ্যযুগে পাবনা জেলার যে সব কবির নাম মেলে তার মধ্যে অদ্ভুত আচার্য বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী। রামায়ণ-অনুবাদক হিসাবে তিনি পরিচিতি। কবির সময়কাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে এ জেলার কৃষ্ণকিশোর রায়, শশধর রায় মধ্যযুগের মতো পাঁচালীর অনুকরণে কাব্য রচনা করেছেন। এ জেলার কবিদের রচিত অন্যান্য উল্লেখ্য কাব্যের মধ্যে প্রসন্নময়ী দেবী বিরচিত ‘নীহারিকা’, রজনীকান্ত সেনের ‘বাণী’ ও ‘অমৃত’, প্রমথ চৌধুরীর ‘সনেট পঞ্চাৎ’ ও ‘পদচারণ’, প্রিয়মব্দা দেবীর ‘রেণু’ এর মধ্যে সমকালীন সমাজ চিত্রে প্রসন্নময়ী দেবী, সনেটে প্রমথ চৌধুর, শোক কাব্যে প্রিয়ম্বদা দেবী, ঐতিহ্য বিষয়ক রচনায় আবুল হাশেম ও পল্লী কবিতায় বন্দে আলী মিয়ার নাম স্মরণীয়। আবু লোহানী প্রমুখ এক বা একাধিক কাব্য লিখেছেন। তাঁদের অনেকেই বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, সে তুলনায় সাহিত্য অঙ্গনে ততটা পরিচিতি লাভে সমর্থ হননি। সাম্প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ মৈত্র, মণীন্দ্র রায়, বাণী রায়, আব্দুল গণি হাজারী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে সংখ্যাগত প্রাচুর্য ও সৃষ্টির বিচিত্রতায় সবচেয়ে প্রদীপ্ত নাম মণীন্দ্র রায়ের। যুগ যন্ত্রণা এবং একই সঙ্গে রোমান্টিকতা তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে। মণীন্দ্র রায়ের ‘মুখের মেলা’, ‘মোহিনী আড়াল’, ‘এই জন্মঃ জন্মভুমি’ কাব্যত্রয়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘রাজধানী ও মধুবংশীয় গলি’, বাণী রায়ের ‘জুপিটার’, তরুণ সান্যালের ‘মাটির বেহালা’, আব্দুল গণি হাজারীর ‘সূর্যের সিড়ি’, জিয়া হায়দারের ‘একাত্তরের কান্না’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘আপন যৌবন বৈরী’, দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ ইত্যাদি কাব্য বাংলা কবিতার ধারার উল্লেখ্য সংযোজন। এদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। মণীন্দ্র রায় ১৯৬৯ সনে তাঁর ‘মোহিনী আড়াল’ কাব্যের জন্য ‘সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার’, আর আব্দুল গণি হাজারী ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ লিখে ১৯৬৪ সনে ‘এশীয় কাব্য পুরস্কার’ লাভ করেছেন। তরুণতম দাউদ হায়দার রচিত ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতাটি লন্ডনের আন্তর্জাতিক কবিতা সমিতি কর্তৃক ১৯৭২ সনের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। ছড়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট নাম বন্দে আলী মিয়া। উপেন্দ্র কিশোর চৌধুরী সম্পাদিত বিখ্যাত শিশু-সাময়িকী ‘সন্দেশ’-এ নিয়মিত লিখতেন প্রসন্নময়ী দেবী। মণীন্দ্র রায় ব্যাঙ্গাত্মক ছড়ার ক্ষেত্রে বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। গজল রচনার ক্ষেত্রে উল্লেখ্য নাম আবুল হাশেম। আধুনিক গানের ক্ষেত্রে আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, ফজলে খোদা প্রমুখের নাম করা যেতে পারে। ছোট গল্পের ক্ষেত্রে কাহিনীর চকমপ্রদ বৈশিষ্ট ও রূপ সৃষ্টির অনন্যতার দিক থেকে প্রমথ চৌধূরীর নাম প্রথমেই উচ্চার্য। তার গল্প সংগ্রহ ‘চার ইয়ারী কথা’, ‘নীল লোহিত’। বাণী রায়ের একটি অত্যন্ত স্মরণীয় সৃষ্টি ‘ময়নামতির কড়চা’। সরদার জয়েন উদ্দিন এর গল্পের বিষয় গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের আলেখ্য। এ ক্ষেত্রে সরদার জয়েন উদ্দিনের বিশেষ সংযোজন-খরশ্রোতা, ‘নয়ান ঢুলী’। এ জেলার অন্যান্য গল্পকারদের মধ্যে বন্দে আলী মিয়া, ফতেহ লোহানী, রশীদ হায়দার প্রমুখের নাম স্মরণীয়। এর পর বাংলা ১২৯৬ সনে বের হয় ‘অশোকা’ রচয়িতা প্রসন্নময়ী দেবী। এ জেলার অন্যানা উপন্যাসিকের মধ্যে আবুল হাশেম, বন্দে আলী মিয়া, বাণী রায়, সরদার জয়েন উদ্দিন, রশীদ হায়দার প্রমুখের নাম উল্লেখ যোগ্য। এর মধ্যে বন্দে আলী মিয়া, বাণী রায় ও সরদার জয়েন উদ্দিনের উল্লেখ্য সংখ্যক উপন্যাস রয়েছে। এ জেলার উপন্যাসিকদের বিশেষ স্মরণীয় সৃষ্টি- রাধাচরণ চক্রবর্তীর ‘মৃগয়া’, বাণী রায়ের ‘প্রেম’, ‘কনে দেখা আলো’, সরদার জয়েন উদ্দিনের ‘অনেক সূর্যের আশা’, রশীদ হায়দার বিরচিত ‘খাঁচায়’। কৌতুক নাট্য রচনায় পরিমল গোস্বামাী বিশেষ সিদ্ধহস্ত। এ ক্ষেত্রে তাঁর সংযোজন- ‘ঘুঘু’, ‘দুষ্মন্তে বিচার’। আবুল হাশেম, বন্দে আলী মিয়া, মণীন্দ্র রায় মুলতঃ নাট্যকার নন। একাধিক নাটক এদের রয়েছে। এর মধ্যে আবুল হাশেমের ‘মাষ্টর সাহেব’, বন্দে আলী মিয়ার ‘মসনদ’ ও মণীন্দ্র রায়ের ‘ভীষ্ম’(কাব্য নাট) ও ‘লখীন্দর’ ইত্যাদি নাম করা চলে। এ ছাড়া জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার বিশিষ্টতা পরিচয় দিয়েছেন। এদের রচনা সংখ্যা সীমিত হলেও বিষয়বস্তু ও শিল্পগত দিক থেকে স্মরণীয়। ভ্রমণ বিষয়ক প্রথম উল্লেখ্য রচনা ‘আর্যবর্ত্য’(১২৯৫)। লেখিকা প্রসন্নময়ী দেবী। পরিমল গোস্বামীর এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান - ‘পথে পথে’ । স্মৃতিকথামূলক রচনা এ জেলায় কিছু পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট নাম প্রসন্নময়ী দেবী। এর রচনা-‘পূর্ব স্মৃতি’। এরপর আত্মকথা লিখেছেন প্রমথ চৌধুরী। এতে হরিপুর, পাবনার স্মৃতি রোমন্থন লক্ষিত হয়। এছাড়া বাংলা ১৩৩৩ সালের কার্তিক সংখ্যা ‘সবুজ পত্রে’ তিনি ‘পাবনার কথা’ নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন। পরিমল গোস্বামীর স্মৃতিচারণমুলক স্মরণীয় সৃষ্টি ‘পত্রস্মৃতি’ ও ‘আমি যাঁদের দেখেছি’। অতীত স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে বন্দে আলী মিয়ার রচনা ‘জীবনের দিনগুলি’। স্মৃতি কথার চেয়ে তুলনামূবকভাবে জীবনচরিত এ জেলায় রচিত অধিক জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে বন্দে আলী মিয়ার ‘জীবন শিল্পী নজরুল’ স্মরণীয়। জীবনকথা বিষয়ক প্রবন্ধে এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে পরিমল গোস্বামী, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, আবু লোহানী প্রমুখ বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। অনুবাদের ক্ষেত্রেও এ জেলার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রসন্নময়ী দেবীর ‘বনলতা’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা ইংরেজী থেকে অনুদিত। কুমুদনাথ চৌধুরী রচিত 'Sports in jheels and jungle’ অনুবাদ করেছেন প্রিয়মব্দা দেবী। এর অনুদিত ‘ঝিলে জঙ্গলে শিকার’ সবুজপত্রের কয়েকটি সংখ্যায় বের হয়। পরিমল গোসাম্বী অনুদিত অন্যতম উল্লেখ্য গ্রন্থ ‘সুখের সন্ধানে’ (মূলঃ বারট্রাগু বাসোল)। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন রুমীর ‘মসনবী শরীফের’ আংশিক অনুবাদ করেছেন। বাণী রায়ের ‘জুপিটার’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা ইংরেজী থেকে অনুদিত। এবং অনুদিত গদ্য রচনা- ‘মোনালিসা’, খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত এপুলিয়াস- এর `Golden ass’ অবলম্বনে আব্দুল গণি হাজারী অনুবাদ করেছেন ‘স্বর্ণ গর্দভ’। এ ক্ষেত্রে তাঁর আর এক উল্লেখযোগ্য প্রয়াস ‘মনসমীক্ষা’ (মূল ফ্রয়েড)। আর্থার মিলার রচিত `Death of a Salesman’ অবলম্বনে ফতেহ লোহানীর রচনা ‘একটি সামান্য মৃত্যু’। ইউীন ও নীল- এর নাটকের অনুবাদ ‘বিলাপে বিলীন’। কবি বন্দে আলী মিঞা শিশু সাহিত্যেও পাবনা জেলার বিশিষ্ট ভুমিকা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এ জেলায় উল্লেখ্য সংখ্যক শিশু সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে প্রসন্নময়ী দেবী, প্রিয়মব্দা দেবী, মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন ও বন্দে আলী মিয়া প্রমুখের নাম করা চলে। এর মধ্যে সংখ্যাগত দিক থেকে বন্দে আলী মিয়ার বইয়ের সংখ্যা পর্যাপ্ত। এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬২ সনে তিনি ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করেছেন। প্রবন্ধের ক্ষেত্রে পাবনা জেলার অবদান ব্যাপক। প্রথমে সাহিত্য সমালোচনা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধের কথা আলোচনা করা যেছে পারে। এতে প্রমথ চৌধুরী, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, ডঃ আবু হেনা মোসতফা কামাল ও জিয়া হায়দার প্রমুখের নাম স্মরণীয়। বাংলা গদ্যের বিবর্তনে ও প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারায় প্রমথ চৌধুরীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য অবদান ‘বীরবলের হালখাতা’, ‘নানা কথা’, ‘নানা চর্চা’। বাগবৈদগ্ধ্য তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর আধুনিক সাহিত্যের ওপর গবেষণায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ডঃ আবু হেনা রচিত গবেষণা নিবন্ধ- `The Bengli press and Literary writings, ১৮১৮-১৮৩১ ও সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘শিল্পীর রুপান্তর’-এ মনস্বিতার পরিচয় মেলে। রম্য রচনার ক্ষেত্রে পরিমল গোস্বামী বিশেষ সিদ্ধহস্ত। নির্মল কৌতুকের প্রচ্ছন্ন লক্ষিত হয় তাঁর রচনায়। পাবনা জেলার সাহিত্য সাধনার নেপথ্যে সাময়িক পত্রের অবদান্ত কম নয়। অনেক সাময়িকী এ জেলা থেকে বের হয়েছে। এর মধ্যে ‘পাবনা দর্পণ’, ‘উদ্যোগবিধায়নী’, ‘আশালতা’, ‘সৎসঙ্গী’, ‘সাম্যবাদ’, ‘সুরাজ’, ‘আমাদের দেশ’, ‘যমুনা’, ‘প্রবাহ’ ও ‘বিবৃতি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এ জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, নানা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত কিংবা যৌথ উদ্যোগে বেশ কিছু বার্ষিকী ও স্মরণিকা বের হয়েছে। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, সাহিত্যক্ষেত্রে পাবনা জেলার ভুমিকা শুধু ব্যাপকইনয়, সুদুরপ্রসারী প্রভাববাহীও বটে। সাহিত্য অংগনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অংগনেরও অনেক কৃতি মানুষের জন্ম হয়েছে পাবনায়। এদের অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে শুধু নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সঙ্গীতে বারীণ মজুমদার, ইলা মজুমদার, প্রমথনাথ চৌধুরী, আব্দুল গফুর, সত্য মজুমদার, মনোয়ারা বেগম, ডলি সায়ন্তনী, বাদশা বুলবুল উল্লেযোগ্য। এছাড়াও অন্য জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও চাকরী/কর্ম সূত্রে পাবনাতে দীর্ঘদিন অবস্থানকালীন সময়ে সাহিত্য সাধনা করেছেন এমন সাহিত্যিকদের সংখ্যাও কম নয়। তন্মধ্যে সরদার আব্দুল হামিদ, কবি আশুতোষ বড়ুয়া প্রমুখ। কিংবদন্তি নায়িকা সূচিত্রা সেন অভিনয় শিল্পকে আলোকিত করেছেন অনেকেই। যেমনঃ সুচিত্রা সেন, তপন লাহিড়ী, আবুল হোসেন, তেজেন চক্রবর্তী, নিশি বকশী। এর মধ্যে অত্যন্ত গর্বের সাথে উল্লেখযোগ্য নাম উপমহাদেশের কিংবদন্তি নায়িকা সূচিত্রা সেন। তার বাবা করুনাময় দাশ গুপ্ত। চাকরি করতেন পাবনা পৌরসভায়। সূচিত্রা সেন বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে বাস করতেন পাবনায়। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন পাবনা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পাবনাবাসি বর্তমানে পাবনা শহরের পুরান টেকনিক্যাল স্কুলের রাস্তার উত্তরে অবস্থিত তার পৈত্রিক বাড়ীকে কেন্দ্র করে সূচিত্রা সেন এর স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।