শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

পাবনা জেলার পটভূমি


পাবনা বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী জনপদ। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবস্থানগত কারণে এ জেলা কৃষি, শিল্প, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে দ্রুত উন্নতিলাভের এক অপার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে এর রয়েছে এক গৌরবময় অতীত ইতিহাস। অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড় আর জলাশয় বেস্টিত পাবনা। বর্তমান পাবনা জেলা রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ পূর্বাংশে ২৩০ ৪৮’ ও ২০ ২১‌’ উত্তর অক্ষরেখা এবং ৮৯০ ও ৮৯০ ৪৪’ পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত। এ জেলার উত্তরে নাটোর ও সিরাজগঞ্জ , পূর্বে সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ, দক্ষিণে কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী এবং পশ্চিমে কুষ্টিয়া ও নাটোর জেলা অবস্থিত। জেলার জলবায়ু কিছুটা চরমভাবাপন্ন।


‘পাবনা’ নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। এক কিংবদন্তি মতে গঙ্গার ‘পাবনী’ নামক পূর্বগামিনী ধারা হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। অপর একটি সূত্রে জানা যায় ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’ নামের একজন দস্যুর আড্ডাস্থলই এক সময় পাবনা নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘পাবনা’ নাম এসেছে ‘পদুম্বা’ থেকে। কালক্রমে পদুম্বাই স্বরসঙ্গতি রক্ষা করতে গিয়ে বা শব্দগত অন্য ব্যুৎপত্তি হয়ে পাবনা হয়েছে। ‘পদুম্বা’ জনপদের প্রথম সাক্ষাৎ মিলে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে পাল নৃপতি রামপালের শাসনকালে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রামপাল হ্নতরাজ্য বরেন্দ্র কৈবর্ত শাসকদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে চৌদ্দজন সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন -এঁদেরই একজন ছিলেন পদুম্বার সোম নামক জনৈক সামন্ত। আবার অনেকের মতে পৌন্ড্রবর্ধন হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। তাঁরা বলেন পৌন্ড্রবর্ধনের বহু জনপদ গঙ্গার উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল। চলতি ভাষায় পুন্ড্রুবর্ধন বা পৌন্ড্রবর্ধন পোনবর্ধন বা পোবাবর্ধন রূপে উচ্চারিত হতে হতে পাবনা হয়েছে। ‘পাবনা’ নামকরণ নিয়ে কিংবদন্তির অন্ত নেই। এক কিংবদন্তি মতে গঙ্গার ‘পাবনী’ নামক পূর্বগামিনী ধারা হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। অপর একটি সূত্রে জানা যায় ‘পাবন’ বা ‘পাবনা’ নামের একজন দস্যুর আড্ডাস্থলই এক সময় পাবনা নামে পরিচিতি লাভ করে। অপরদিকে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘পাবনা’ নাম এসেছে ‘পদুম্বা’ থেকে। কালক্রমে পদুম্বাই স্বরসঙ্গতি রক্ষা করতে গিয়ে বা শব্দগত অন্য ব্যুৎপত্তি হয়ে পাবনা হয়েছে। ‘পদুম্বা’ জনপদের প্রথম সাক্ষাৎ মিলে খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে পাল নৃপতি রামপালের শাসনকালে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রামপাল হ্নতরাজ্য বরেন্দ্র কৈবর্ত শাসকদের নিকট থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে চৌদ্দজন সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন -এঁদেরই একজন ছিলেন পদুম্বার সোম নামক জনৈক সামন্ত। আবার অনেকের মতে পৌন্ড্রবর্ধন হতে পাবনা নামের উৎপত্তি হয়েছে। তাঁরা বলেন পৌন্ড্রবর্ধনের বহু জনপদ গঙ্গার উত্তর দিকে অবস্থিত ছিল। চলতি ভাষায় পুন্ড্রুবর্ধন বা পৌন্ড্রবর্ধন পোনবর্ধন বা পোবাবর্ধন রূপে উচ্চারিত হতে হতে পাবনা হয়েছে। সাবেক পাবনা (সিরাজগঞ্জ জেলাসহ) জেলা রূপে গঠিত এলাকাটি প্রাচীন যুগে পূর্ব ভারতের বঙ্গ ও পুন্ড্রুবর্ধন জনপদের অংশ ছিল। গঙ্গারিডির রাজত্বের অবসানের পর বৃহত্তর পাবনা মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। রাজা অশোক পুন্ডুসহ সমগ্র বাঙলা নিজ শাসনাধীনে এনেছিলেন। জেলাটির প্রায় সম্পূর্ণই মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। মৌর্য বংশের পতনের পর পাবনা জেলাসহ বাংলার এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অবস্থার ইতিহাস অজ্ঞতার অন্ধকারে চাপা পড়ে যায়। এ অঞ্চল সমুদ্রগুপ্তের সময়ে (৩৪০-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ) গুপ্ত সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং প্রথম কুমার গুপ্তের (৪১৩-৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে পাবনা (সিরাজগঞ্জসহ) জেলা উত্তর বাংলার পুন্ড্রবর্ধন ভুক্তি নামে গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগে পরিণত হয়েছিল। গুপ্ত রাজাদের পতনের পর এই অঞ্চল খুব সম্ভবতঃ পরবর্তী গুপ্তদের অধীনে মহাসেন গুপ্তের রাজত্বকাল পর্যন্ত শাসিত হয়েছিল। তিনি ৬ষ্ঠ শতকের শেষের দিকে বাংলার এ অংশে রাজত্ব করেছিলেন। সপ্তম শতকের প্রারম্ভে শশাংক পরবর্তী গুপ্তদের উচ্ছেদ সাধনে সাফল্য অর্জন করেন। তিনি উত্তর ও পশ্চিম বাংলা এবং মগধ নিয়ে গৌড় রাজ্য নামেএকটি স্বাধীন শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেন। ৬৩৭ খ্রিঃ শশাংকের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন এই অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হন। এ সময়ে ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে চীন দেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বাংলাদেশ পরিভ্রমণে আসেন। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রাচীন বাংলার এ অংশের প্রায় দেড়শত বছরের ইতিহাস অজানার অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে। এ সময়ে (৬০০-৭৫০ খ্রিঃ) বাংলায় রাজনৈতিক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। কেন্দ্রে কোন শাসন ছিলনা। এক চরম অরাজক অবস্থা। ইতিহাসে এ সময়কে মাৎস্যন্যায় বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অষ্টম শতকের প্রারম্ভে ৭২৩ এবং ৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে কনৌজের যশোবর্ধন গৌড়রাজকে পরাজিত করে বাংলাদেশ দখল করেন এবং পাবনা জেলাসহ প্রায় সমগ্র বাংলা তাঁর হস্তগত হয়। ৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যলোবর্ধনকে পরাজিত করে এ অঞ্চলের উর প্রভুত্ব বিস্তার করে। পরবর্তীকালে পাবনা পালদের অধীনে এসে যায়। পাল বংশের (আনুমানিক ৭৫৮-১১৬২ খ্রিঃ) অন্তত ১৭ জন রাজা তাদের স্ব-স্ব রাজত্বকালে পাবনার উপর কর্তৃত্ব করে গিয়েছিলেন। রাম পালের মৃত্যুর পর (১১২৫ খ্রিঃ) পাল রাজবংশের অস্তিত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা পর্যায়ে সেন বংশের রাজাগণ এ অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। পালদের পতনের যুগে চালুক্য যুবরাজ ৬ষ্ঠ বিক্রমাদিত্য যখন বাংলা আক্রমন করেন সম্ভবত তখন সেনরা দক্ষিণ ভারত থেকে তার সংগে এখানে আগমন করেন। প্রথমে তারা পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করেন। অতঃপর রামপালের রাজত্বকালে উত্তর বাংলায় স্বাধীন রাজত্বের সূচনা করেন। সেন বংশের প্রথম প্রসিদ্ধ রাজা বিজয় সেন শেষ পাল রাজা মদন পালকে পরাজিত করেন। তাঁর রাজত্বকালে পাবনা অধিকারে আসে। তিনি রামপুর গোয়ালিয়া থেকে ৫ মাইল পশ্চিমে গোদাগাড়ীর সন্নিকটে বিজয় নগরে রাজধানী স্থানান্তর করেন। লক্ষণ সেনের(সেন রাজবংশের শেষ রাজা) রাজত্বের শেষ ভাগে সেন রাজ্যের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা দেয়। এই সময় ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমন করেন এবং লক্ষণাবতী অধিকার করে নেন। ঐ সময় পাবনা জেলা মুসলমানদের অধিকারে আসে। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে তার নব বিজিত রাজ্য শাসন করেন। ১২০৫ সাল হতে পাবনা জেলা গৌড়ের মুসলিম শাসকদের অধিকারে ছিল। ১২০৬ সালে মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর মৃত্যুর পর মুহম্মদ সিরাণ খলজি এ অঞ্চলের কর্তৃত্ব লাভ করেন। সুলতান আলাউদ্দিন উপাধি ধারণপূর্বক তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। অতঃপর দিল্লীর সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের নিকট থেকে আলী মর্দান লক্ষণাবতীর রাজ প্রতিনিধিত্ব লাভ করেন। ১২১০ সালে কুতুব উদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর আলী মর্দান দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষনা করেন এবং সুলতান উপাধি ধারণ করেন। প্রায় তিন বৎসর কাল তিনি এ জেলার উপর তার শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। তিনি খলজি আমীরগণের হাতে ১২১২ সালে নিহত হন। এই আমীরগণ অতঃপর লাখনৌতির শাসনকর্তা হিসেবে গিয়াস উদ্দিন ইওয়াজ খলজীকে মনোনীত করেন। তিনি সুলতান উপাধি ধারণপূর্বক প্রায় ১৪ বৎসর রাজ্য শাসন করেন। অতঃপর ১২২৭ সালে সুলতান ইলতুতমিশের পুত্র যুবরাজ নাসির উদ্দিনের হাতে সুলতান গিয়াস উদ্দিন নিহত হলে যুবরাজ নাসির উদ্দিন লাখনৌতির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২২৭-১২৮২ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ জন শাসনকর্তা লাখনৌতির শাসন কার্য পরিচালনা করেন। ঐ সময়ে লক্ষণাবতীর কোন শাসনকর্তাই দিল্লীর সুলতানের আনুগত্য স্বীকার করেননি। সুলতান মুগিস উদ্দিন তুঘরিল ১৬ জন শাসনকর্তাদের মধ্যে শেষ ব্যক্তি ছিলেন। তখন দিল্লীর সুলতান ছিলেন গিয়াস উদ্দিন বলবন। তিনি লক্ষ্মণাবতীর শাসনকর্তার আনুগত্য বরদাস্ত করতে পারেননি। তাঁকে দমন করার জন্য তিনি বাংলা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে ১২৮২ সালে তুঘরিল পরাজিত ও নিহত হলে সুলতান বলবন তদীয় পুত্র বোগরা খানকে লাখনৌতির শাসনকর্তা নিয়োজিত করেন। পরবর্তী সময়ে বোগরা খাঁন দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সুলতান নাছির উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ উপাধি ধারণ করেন। ১৩২৪ সাল পর্যন্ত লাখনৌতির স্বাধনীতা অক্ষুন্ন থাকে। ঐ বৎসর দিল্লীর সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক লাখনৌতিকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে নেন। দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ বিন তুগলকের (১৩২৫-১৩৫১ সাল) রাজত্বের পতনোত্তর সময়ে জনৈক হাজী ইলিয়াস শাহ লাখনৌতির সিংহাসনে আরোহন করেন। নিঃসন্দেহে পাবনা জেলা হাজী ইলিয়াস শাহের (১৩৪২-১৩৫৭) রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তদীয় উত্তরাধীকারী সিকান্দার শাহ, সায়ফুদ্দিন হামজা শাহ, শিহাবুদ্দিন বায়েজিদ শাহ, আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ প্রভৃতি নরপতিগণ এ জেলার উপর তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। অতঃপর রাজা গণেশ ১৪১৪ সালে লাখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন। শীঘ্রই তাঁর মৃত্যু ঘটায় রাজত্বকাল স্বল্পস্থায়ী হয়। অতঃপর তদীয় উত্তরাধিকারী ও পুত্র যদু ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন ও জালাল উদ্দিন নাম গ্রহণ করেন। জালাল উদ্দিন ১৪৩২ সাল পর্যন্ত এই জেলার উপর তাঁর শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। তারপর তদীয় পুত্র সামছুদ্দিন আহমদ শাহ ১৪৪২ সাল পর্যন্ত এই এলাকা শাসন করেন। উক্ত সামছুদ্দিন আহমদ শাহকে হত্যা করে জনৈক নাসির উদ্দিন আবুল মোজাফফর মাহমুদের মাধ্যমে ইলিয়াসশাহী রাজ বংশ পুনঃ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৪৮৭ সাল পর্যন্ত এ জেলা উক্ত ইলিয়াসশাহী রাজবংশের শাসনাধীনে ছিল। অতঃপর ১৪৯৩ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের প্রশাসন ব্যবস্থায় বিভ্রান্তি ও বিশৃংখলা বিরাজ করছিল। এ সময়ে আবিসিনীয় অধিবাসীরা ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মাধ্যমে ইলিয়াসশাহী রাজবংশকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতা দখল করে। এদের শেষ রাজা সামছুদ্দিন মোজাফফর শাহ (১৪৯১-১৪৯৩) তদীয় উজির সাঈদ হোসেন কর্তৃক নিহত হলে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উপাধি ধারণ করে ১৪৯৩ সালে তিনি লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই এ জেলা আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনাধীনে ছিল। তাঁর উত্তরাধিকারীগণ ১৫৩৮ সাল পর্যাপ্ত এই জেলার উপরে তাদের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে এ অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসে এবং দেশে সুশাসন কায়েম হয়। এ সময়ে রাজনৈতিক সম্প্রীতি বিস্তৃতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের সমৃদ্ধির ঘটে। অতঃপর দিল্লীর সুলতান শের শাহ শুরী(১৫৩৯-১৫৪৫ সাল) কর্তৃক বাংলা বিজয়ের ফলে ১৫৩৮ সালে হোসেন শাহী রাজবংশের রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। অতঃপর শেরশাহের মৃত্যুর পর ইসলাম শাহ(১৫৪৫-১৫৫৩ খ্রিঃ) এ জেলার উপর তাঁর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর বাংলার শাসনকর্তা শুর বংশীয় মাহমুদ খান শুর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সামছুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ গাজী (১৫৫৩-১৫৫৬ সাল) উপাধি ধারণ করে পাবনা জেলায় তাঁর শাসন ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র গিয়াসুদ্দিন বাহাদুরশাহসহ তদীয় উত্তরাধীকারগণ ১৫৬৫ সাল পর্যন্ত এ জেলার উপর তাদের শাসন ক্ষমতা অব্যাহত রাখেন। এ সময়ে তাজ খান কররানী লাখনৌতির সিংহাসন দখল করলে পাবনা জেলা তার শাসনাধীনে চলে যায়। এভাবে ১৫৭৪ সাল পর্যন্ত দাউদ কররানী এ জেলার কর্তৃত্ব করেন। তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে মুঘল সেনাপতি মুনিম খানের নিকট পরাজিত ও নিহত হন এবং ১৫৭৬ সালে লাখনৌতি বা গৌড়রাজ্যে মুঘল শাসনের সূচনা ঘটে। পাবনা জেলা এ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত থাকায় তা ঐ একই বছর মুঘল শাসনাধীনে এসে যায়। ১৫৭৬-১৭২৭ সাল পর্যন্ত দিল্লীর মুঘল সম্রাজ্যের অধীনে ২৯ জন শাসনকর্তা এ জেলার উপর তদের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এদের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি সম্পন্ন ছিলেন রাজা মানসিংহ, ইসলাম খাঁ, শাহজাদা মুহম্মদ সুজান, মীর জুমলা, নবাব সায়েস্তা খাঁ, নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ। সুদীর্ঘ মুঘল শাসনাধীন সময়ে পাবনা জেলায় শান্তি ও প্রগতির এক নুতন যুগের সূচনা হয়। নবাব মুর্শিদকুলী খানের (১৭০০-১৭২৭ সাল) অধীনে কার্যতঃ বাংলা স্বাধীন হয়। তিনি কঠোর রাজস্বনীতি অবলম্বন করেন। এর ফলে পূর্ববর্তী আমলের জমিদারগণ রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের জমিদারী কেড়ে নিয়ে নবাবের অনুগ্রহ ভাজনদের মধ্যে বিলি করা হয়। এভাবে উত্তরাধীকারী সূত্রে রাজা হওয়ার পরিবর্তে নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয় এবং বাসতবিক পক্ষে সমসত বাংলার মধ্যে এই জেলার রাজাদের প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন নাটোর রাজ। নাটোর রাজার পরিবারের সদস্যগণ বরেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণদের মৈত্র পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত পদ্ধতিতে নবাব মুর্শিদকুলী খানের দেওয়ান থাকা অবস্থায় ১৭০৭ সাল থেকে এ সকল জমিদারি নাটোর রাজের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাম জীবনকে প্রদান করা হয় এবং তিনি ১৭৩০ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনা করেন। এতে পাবনা জেলা অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৭২৭-১৭৩৯ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা তৎকালীন সুবেদার নবাব সুজা উদ্দিনের শাসনাধীনে ছিল এবং রাজশাহীর জমিদারির রাজস্ব শাসন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন রাম জীবন। ১৭৩০ সালের পর রাম জীবনের উত্তরাধিকারী মহারাজ রামকান্তের উপর রাজস্ব শাসন ব্যবস্থা অর্পিত হয়। আলীবর্দী খাঁ ১৭৪২-১৭৫৬ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন। মহারাজ রামকান্তের মৃত্যুর পর এ বিশাল জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব রানী ভবানীর উপর এসে পড়ে। এই প্রতিভাময়ী মহিলা পলাশী, উদয় নালা, বকসার যুদ্ধ এবং লর্ড ক্লাইভের দ্বৈত শাসন ও অষ্টাদশ শতকের বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোকক্ষয়কারী মহাদুর্ভিক্ষের অরাজকতা পূর্ণ সময়ে দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী কালব্যাপী দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে এই বিশাল জমিদারির শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন। আলীবর্দী খাঁর শাসনামলে পাবনা জেলা মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ১৭৫৬ সালে আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তদীয় দৌহিত্র উত্তরাধিকারী নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা বাংলা সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং এক বছরকাল পাবনা জেলাসহ সমগ্র বাংলার শাসন ক্ষমতা বজায় রাখেন। ১৭৫৭ সাথে তাঁর রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং এই সংগে শেষ হয় বাংলার স্বাধীন মুসলিম রাজত্ব। ১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে বাংলায় তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে বক্সারের যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার দেওয়ানী লাভ করে। অথচ রাজশাহীর জমিদারির রাজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থায় কোনরূপ হসতক্ষেপ করা হয়নি। পাবনা জেলা প্রধানতঃ রাজশাহীর জমিদারির অন্তর্ভূক্ত থাকায় একমাত্র রানী ভবানীই কোম্পানীকে এর ভূমি রাজস্ব প্রদানের জন্য দায়ী ছিলেন। জেলার একাংশ অবশ্য বড়বাজু ও কাগমারী জমিদারির অন্তর্ভূক্ত ছিল যা বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। সিরাজগঞ্জ জেলার বৃহত্তর অংশ নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর আমলে (১৭০৩-১৭২৬ সাল) বড়বাজু ও কাগমারী জমিদারির অংশ ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিট্রিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষক ও কারিকরদের বিদ্রোহ ঘটে। সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে এই বিদ্রোহ ‘‘ফকির ও সন্নাসী’’ বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলার ফকির সম্প্রদায়ের দলপতি শাহ মস্তান বোরহানা উত্তর বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্রিট্রিশ বিরোধী কাজে তৎপর ছিলেন। এ সময় সিরাজগঞ্জের নিকটে ফকিররা খুবই তৎপর ছিল। মজনু শাহ ১৭৮৭ সালে তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত পাবনা ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহে (রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ) তৎপর ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় জেলার বেশিরভাগ অংশ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। বাংলার এই অংশে প্রধানতঃ বহু সংখ্যক ডাকাত দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকায় ১৮২৮ সালে এটিকে একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসাবে গঠন করা হয়। আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং অধিবাসীদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পাবনায় সাময়িকভাবে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয় ১৮২৮ সালে। ১৮৩২ সালে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়োগ স্থায়ী করা হয় এবং এই সময় তাঁকে একজন স্বতন্ত্র ডেপুটি কালেক্টর রূপে নিযুক্তি প্রদান করা হয়। স্বতন্ত্র জেলা সৃষ্টির প্রাক্কালে রাজশাহীর পাঁচটি থানা আলাদা করে জেলাটি গঠিত হয়। এসব থানা ছিল রাজশাহী থেকে ক্ষেতপাড়া, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুর, মত্থরা ও পাবনা এবং যশোরের ৪ টি থানা। ১৮৪৮ সালে জেলার পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত হিসাবে যমুনা নদীকে স্থির করা হয় এবং এ নদীর গতি ধারায় পরিবর্তনের দরুন ১৮৫৫ সালে সিরাজগঞ্জ থানাটি ময়মনসিংহ থেকে নিয়ে পাবনার সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৮৫৯ সালে একজন ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর রাখার বর্তমান পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং একই সময়ে এতকাল যাবত পাবনার অংশ হিসেবে পরিগণিত পাংশা, খোক্সা ও বালিয়াকান্দি এই তিনটি থানা নিয়ে স্বতন্ত্র ‘‘কমরকলি’’ (কুষ্টিয়া কুমারখালী) মহকুমা গঠন করা হয়। পদ্মার দক্ষিণে এক বিরাট ভূখন্ড তখনও এ জেলার অধীন ছিল। ১৮৬০ সালে কুষ্টিয়া মহকুমা নদীয়ার সংগে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৮৭১ সালে পাবনা থেকে পাংশা থানা ফরিদপুর জেলার গোয়ালন্দ মহকুমার এবং কুমারখালী থানা নদীয়ার কুস্টিয়া মহকুমার সাথে সংযুক্ত করা হয়। এভাবে জেলার দক্ষিণ সীমানা পদ্মা নির্ধারিত হয়। ঊনিশ শতাব্দির ফরায়েজী ও তারিকৎ-ই-মুহাম্মদীয়া আন্দোলন দুটির দ্বারা পাবনা জেলার অধিবাসীগণ ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত হয়। ১৮১৮ সালে ফরায়েজী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তারিকৎ-ই-মুহাম্মদী আন্দোলন সৈয়দ আহমেদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ কর্তৃক সূচিত হয় ১৮১৮ সালে। ১৮২০ সালে সৈয়দ আহমেদ শহীদ কলকাতা সফর করেন এবং অসংখ্য লোক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেই থেকে তারিকৎ-ই-মুহাম্মদীয়া আন্দোলনের প্রভাব পাবনা জেলাসহ বাংলার অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫৭ সালে ভারত বর্ষের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে(ইংরেজের চোখে সিপাহী বিদ্রোহ) এই জেলা নীরব ছিল। এই জেলার মধ্য দিয়ে ঢাকার বিদ্রোহীদের উত্তর বাংলায় গমন পথে বাধা সৃষ্টি করার জন্য পাবনা জেলার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ রেভেন্স জেলার নীলকর সাহেবগণকে সৈন্যদল গঠন করতে নির্দেশ দেন। এই বিদ্রোহের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের অবসান ঘটে তখন স্বভাবতঃই পাবনা জেলা ১৮৫৮ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসনাধীনে চলে যায়। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সমগ্র পাবনা জেলাব্যাপী নীলের চাষ ও নীল তৈরীর কাজ ব্যাপকভাবে চালানো হয়। নীলচাষ চাষিদের নিকট কখনো জনপ্রিয়তা লাভ করেনি। কেননা জমিদারগণ এর বিরুদ্ধে ছিলেন এবং নীলের জমির উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে রায়তদের লাভ করার আশা নির্মূল করে দিতেন। এই জেলার নীলকরদের পীড়ন নীতির ফলে কৃষকরা ১৮৫৯-৬০ সালে বিদ্রোহ করে। ফলে নীলের চাষ ও নীল তৈরীর কাজ নীল চাষিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। নীল বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনয়ন করে। দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য জেলায় জেলায় কালেক্টরের পদ সৃষ্টি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়। মিঃ জি ব্রাইট এই জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট-কালেক্টর নিযুক্ত হন। ১৮৭২-৭৩ সালে পাবনা জেলায় ভূ-সম্পত্তি সংক্রান্ত গোলযোগ দেখা দেয় এবং তা কৃষক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৮৫ সালে বেংগল টেনান্সি এ্যাক্ট জারির মাধ্যমে সমগ্র বাংলাসহ এই জেলায় কৃষক আন্দোলন স্তিমিত হয়। লর্ড কার্জনের শাসনামলে (১৮৯৯-১৯০৫ সাল) বঙ্গ ভঙ্গের ফলে পাবনা জেলা নতুন প্রদেশ পূর্ব বাংলা ও আসামের সংগে যুক্ত হয়। অবশ্য ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গ ভঙ্গ রদ হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট তারিখে পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটায় এই জেলা (সিরাজগঞ্জসহ) পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই সাবেক পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার জনগণের মনে পাকিস্তানের তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শাসক সম্প্রদায়ের বৈষম্য ও শোষণমূলক নীতি ও আচরণের ফলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। তাছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ পুর্ব বাংলার মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে সমস্ত পাকিস্তানের জন্য একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার ফলে পুর্ব বাংলার তরুণ, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবি সমাজ পাকিস্তান সরকারের এই একতরফা ও অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাডাঁয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবী আদায়ের জন্য বাঙালিরা স্বাধীকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালির এ ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় এক দীপ্ত ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে আন্দোলনের একচ্ছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাকে পাবনাবাসীও একাত্ব হয়ে যায়,। পাবনার জেলা ও থানায় থানায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২৩ মার্চ পাবনার টাউন হলে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। পরপরই পতাকা উত্তোলিত হয় জেলা প্রশাসকের বাসভবনে। জেলা প্রশাসক জনাব এম নূরুল কাদের খান মুক্তিকামী জনতার জন্য পুলিশ লাইনের অন্ত্র ভান্ডার খুলে দিয়ে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হবার আহবান জানান। ২৬ মার্চ রাতে পাক সেনারা বিসিক শিল্পনগরীতে ঘাটি করে এবং টেলিগ্রাফ অফিস, সার্কিট হাউজ, স্টেডিয়াম, ডাকবাংলো দখলে নেয়। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় পাকসেনারা পুলিশ লাইন আক্রমন করে। ব্যারাকের পুলিশ সদস্যরা গড়ে তোলে প্রতিরোধ। তাদের সাথে যোগ দেয় জেল পুলিশ। শহরের মুক্তিকামী জনতার সাথে প্রতিরোধে অংশ নেয় চরাঞ্চল এবং গ্রাম অঞ্চল থেকে আশা হাজার হাজার মানুষ। টেলিগ্রাফ অফিসসহ বিভিন্ন স্থানের প্রতিরোধে টিকতে না পেরে ২৮ মার্চ পাকসেনারা পালিয়ে যায় রাজশাহীতে। ২৯ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা ছিল স্বাধীন। বাংলাদেশের মানচিত্রে সম্মুখ সমরে প্রথম শত্র্রু অবমুক্ত জনপদ হওয়ার দূর্লভ গৌরব অর্জন করে পাবনা। ৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে কোর্ট ভবনের সামনে বাংলাদেশর পতাকা উত্তোলিত হয়। ১১ এপ্রিলে পাকসেনারা আবার চলে আসে পাবনাতে। জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ হয়, অতঃপর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তথ্য প্রবাহের সুযোগ না থাকায় এবং ১৭ তারিখ পর্যন্ত পাকসেনারা দখলরত থাকায় পাবনা শত্রুমুক্ত হয় ১৮ মার্চ।

এক নজরে পাবনা জেলা
  সাধারণ তথ্যাবলী আয়তনঃ ২,৩৭১.৫০ বর্গ কিঃ মিঃ লোকসংখ্যাঃ ২২,৬০,৫৪০ (ক) পুরুষ (খ) মহিলাঃঃ ১১,৫৬,৮০৯ ১১,০৩,৭৩১ খানার সংখ্যাঃ ৪,৪২,০৪৯ টি উপজেলার সংখ্যাঃ ৯ টি থানার সংখ্যাঃ ১০ টি পৌরসভার সংখ্যাঃ ৯ টি (আটঘরিয়া পৌরসভা-নবগঠিত) ইউনিয়নের সংখ্যাঃ ৭৩ টি গ্রামের সংখ্যাঃ ১,৫৪৯ টি মৌজার সংখ্যাঃ ১,৩২১ টি ডাকঘরঃ ১৪৫ টি টেলিফোন অফিসঃ ৯ টি ডাকবাংলো ও রেষ্ট হাউজঃ ১৬ টি সরকারী শিশু সদনঃ ১ টি স্টেডিয়ামঃ ৩ টি পাবলিক লাইব্রেরীঃ ৩ টি মসজিদঃ ২,১১২ টি মন্দিরঃ ৩৪৫ টি গীর্জাঃ ৯ টি সেবা আশ্রমঃ ২ টি নদী বন্দরঃ ৩ টি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধঃ ১ টি আধুনিক সুইমিং পুলঃ ১ টি বিমান বন্দরঃ ১ টি (বর্তমানে চালু নেই ) দৈনিক পত্রিকাঃ ৭ টি সাপ্তাহিক পত্রিকাঃ ৬ টি এন,জি,ও শাখাঃ ৫১ উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানঃ লালন শাহ্ সেতু, হার্ডিঞ্জ ব্রীজ, মানসিক হাসপাতাল, জোড় বাংলো, আজিম চৌধুরীর জমিদার বাড়ী (দুলাই), শাহী মসজিদ (ভাড়ারা), শ্রী শ্রী অনুকৃল চন্দ্র ঠাকুরের আশ্রম, নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলস্, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্র, পাবনা সুগার মিল্স, ঈশ্বরদী বিমান বন্দর, কৃষি ফার্ম, নগরবাড়ী/ নটাখোলা ঘাট, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল। রাজস্ব বিষয়ক উপজেলা ভূমি অফিসঃ ৯ টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসঃ ৫৮ টি পৌর ভূমি অফিসঃ ৮ টি খাস জমির পরিমাণঃ ৬,৯২৬.৯৬১১ একর ক) কৃষিঃ ৬,৮৪৭.৮৬১১ একর খ) অকৃষিঃ ৭৯.১০ একর জলমহালঃ ১১৮ টি আদর্শ গ্রাম ( প্রকল্প-১)ঃ ২৩ টি ( প্রথম পর্যায়ে বাস্তবায়িত ) উপকার ভোগী পরিবারঃ ৮১১ আদর্শ গ্রাম (প্রকল্প-২) প্রেরিত প্রস্তাবঃ ৭ টি অনুমোদিতঃ ৭ টি জমির পরিমাণঃ ১৬৬.৮৫ একর আশ্রয়ন ঃ ১০ টি ; পরিবার- ৫৭০ টি আবাসনঃ ৩ টি ; পরিবার- ৫০ টি + ৩০টি =৮০ টি। মৌজাঃ ১,৩২১ টি শিক্ষা বিষয়ক প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ ১,০৮৬ টি ক) সরকারীঃ ৬৬৪ টি খ) বেসরকারীঃ ৪২২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ ২০২ টি ক) সরকারীঃ ৩ টি খ) বেসরকারীঃ ১৯৯ টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ ৪৯ টি মাদ্রাসাঃ ১২৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজঃ ১ টি মহাবিদ্যালয়ঃ ৪৮ টি ক) সরকারীঃ ৪ টি খ) বেসরকারীঃ ৪৪ টি মেডিক্যাল কলেজঃ ১ টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ঃ ১ টি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ঃ ৩ টি ক্যাডেট কলেজঃ ১ টি পলিটেকনিক ইনষ্টিটিটঃ ১ টি ভোকেশনাল ইনষ্টিটিউটঃ ১ টি কমার্শিয়াল ইনষ্টিটিউটঃ ১ টি আইন কলেজঃ ১ টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষক ইনষ্টিটিউটঃ ১ টি টেক্সটাইল ইনষ্টিটিউটঃ ১ টি সেবিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রঃ ১ টি হোমিওপ্যাথিক কলেজঃ ১ টি মক্তব/ ফোরকানিয়া মাদ্রাসাঃ ২৬৪ টি  

পাবনার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব
ঐতিহ্যে সমৃদ্ধময় নদীমাতৃক জেলা পাবনা। এর মাটির গন্ধ, শ্যামল প্রকৃতি মনে রেখাঙ্কন করে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এ জেলার অবদান নগন্য নয়। কালের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানে আবির্ভাব ঘটেছে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিকের। এই সব শিল্পীর অনবদ্য অবদানে আমাদের সাহিত্য হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী পাবনা জেলার যে সব শিল্পী-সাহিতিাকের নাম এতে আলোচিত হয়েছে, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এদের বিশেষ ভুমিকা লক্ষ্যণীয়। প্রথমে কবিতা প্রসংগে আলোচনা করা যেতে পারে। মধ্যযুগে পাবনা জেলার যে সব কবির নাম মেলে তার মধ্যে অদ্ভুত আচার্য বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী। রামায়ণ-অনুবাদক হিসাবে তিনি পরিচিতি। কবির সময়কাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে এ জেলার কৃষ্ণকিশোর রায়, শশধর রায় মধ্যযুগের মতো পাঁচালীর অনুকরণে কাব্য রচনা করেছেন। এ জেলার কবিদের রচিত অন্যান্য উল্লেখ্য কাব্যের মধ্যে প্রসন্নময়ী দেবী বিরচিত ‘নীহারিকা’, রজনীকান্ত সেনের ‘বাণী’ ও ‘অমৃত’, প্রমথ চৌধুরীর ‘সনেট পঞ্চাৎ’ ও ‘পদচারণ’, প্রিয়মব্দা দেবীর ‘রেণু’ এর মধ্যে সমকালীন সমাজ চিত্রে প্রসন্নময়ী দেবী, সনেটে প্রমথ চৌধুর, শোক কাব্যে প্রিয়ম্বদা দেবী, ঐতিহ্য বিষয়ক রচনায় আবুল হাশেম ও পল্লী কবিতায় বন্দে আলী মিয়ার নাম স্মরণীয়। আবু লোহানী প্রমুখ এক বা একাধিক কাব্য লিখেছেন। তাঁদের অনেকেই বিশিষ্ট প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, সে তুলনায় সাহিত্য অঙ্গনে ততটা পরিচিতি লাভে সমর্থ হননি। সাম্প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ মৈত্র, মণীন্দ্র রায়, বাণী রায়, আব্দুল গণি হাজারী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, দাউদ হায়দার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে সংখ্যাগত প্রাচুর্য ও সৃষ্টির বিচিত্রতায় সবচেয়ে প্রদীপ্ত নাম মণীন্দ্র রায়ের। যুগ যন্ত্রণা এবং একই সঙ্গে রোমান্টিকতা তাঁর রচনায় ফুটে উঠেছে। মণীন্দ্র রায়ের ‘মুখের মেলা’, ‘মোহিনী আড়াল’, ‘এই জন্মঃ জন্মভুমি’ কাব্যত্রয়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘রাজধানী ও মধুবংশীয় গলি’, বাণী রায়ের ‘জুপিটার’, তরুণ সান্যালের ‘মাটির বেহালা’, আব্দুল গণি হাজারীর ‘সূর্যের সিড়ি’, জিয়া হায়দারের ‘একাত্তরের কান্না’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘আপন যৌবন বৈরী’, দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ ইত্যাদি কাব্য বাংলা কবিতার ধারার উল্লেখ্য সংযোজন। এদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। মণীন্দ্র রায় ১৯৬৯ সনে তাঁর ‘মোহিনী আড়াল’ কাব্যের জন্য ‘সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার’, আর আব্দুল গণি হাজারী ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’ লিখে ১৯৬৪ সনে ‘এশীয় কাব্য পুরস্কার’ লাভ করেছেন। তরুণতম দাউদ হায়দার রচিত ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ কবিতাটি লন্ডনের আন্তর্জাতিক কবিতা সমিতি কর্তৃক ১৯৭২ সনের শ্রেষ্ঠ কবিতা হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। ছড়ার ক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট নাম বন্দে আলী মিয়া। উপেন্দ্র কিশোর চৌধুরী সম্পাদিত বিখ্যাত শিশু-সাময়িকী ‘সন্দেশ’-এ নিয়মিত লিখতেন প্রসন্নময়ী দেবী। মণীন্দ্র রায় ব্যাঙ্গাত্মক ছড়ার ক্ষেত্রে বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। গজল রচনার ক্ষেত্রে উল্লেখ্য নাম আবুল হাশেম। আধুনিক গানের ক্ষেত্রে আবু হেনা মোস্তফা কামাল, জিয়া হায়দার, ফজলে খোদা প্রমুখের নাম করা যেতে পারে। ছোট গল্পের ক্ষেত্রে কাহিনীর চকমপ্রদ বৈশিষ্ট ও রূপ সৃষ্টির অনন্যতার দিক থেকে প্রমথ চৌধূরীর নাম প্রথমেই উচ্চার্য। তার গল্প সংগ্রহ ‘চার ইয়ারী কথা’, ‘নীল লোহিত’। বাণী রায়ের একটি অত্যন্ত স্মরণীয় সৃষ্টি ‘ময়নামতির কড়চা’। সরদার জয়েন উদ্দিন এর গল্পের বিষয় গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের আলেখ্য। এ ক্ষেত্রে সরদার জয়েন উদ্দিনের বিশেষ সংযোজন-খরশ্রোতা, ‘নয়ান ঢুলী’। এ জেলার অন্যান্য গল্পকারদের মধ্যে বন্দে আলী মিয়া, ফতেহ লোহানী, রশীদ হায়দার প্রমুখের নাম স্মরণীয়। এর পর বাংলা ১২৯৬ সনে বের হয় ‘অশোকা’ রচয়িতা প্রসন্নময়ী দেবী। এ জেলার অন্যানা উপন্যাসিকের মধ্যে আবুল হাশেম, বন্দে আলী মিয়া, বাণী রায়, সরদার জয়েন উদ্দিন, রশীদ হায়দার প্রমুখের নাম উল্লেখ যোগ্য। এর মধ্যে বন্দে আলী মিয়া, বাণী রায় ও সরদার জয়েন উদ্দিনের উল্লেখ্য সংখ্যক উপন্যাস রয়েছে। এ জেলার উপন্যাসিকদের বিশেষ স্মরণীয় সৃষ্টি- রাধাচরণ চক্রবর্তীর ‘মৃগয়া’, বাণী রায়ের ‘প্রেম’, ‘কনে দেখা আলো’, সরদার জয়েন উদ্দিনের ‘অনেক সূর্যের আশা’, রশীদ হায়দার বিরচিত ‘খাঁচায়’। কৌতুক নাট্য রচনায় পরিমল গোস্বামাী বিশেষ সিদ্ধহস্ত। এ ক্ষেত্রে তাঁর সংযোজন- ‘ঘুঘু’, ‘দুষ্মন্তে বিচার’। আবুল হাশেম, বন্দে আলী মিয়া, মণীন্দ্র রায় মুলতঃ নাট্যকার নন। একাধিক নাটক এদের রয়েছে। এর মধ্যে আবুল হাশেমের ‘মাষ্টর সাহেব’, বন্দে আলী মিয়ার ‘মসনদ’ ও মণীন্দ্র রায়ের ‘ভীষ্ম’(কাব্য নাট) ও ‘লখীন্দর’ ইত্যাদি নাম করা চলে। এ ছাড়া জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার বিশিষ্টতা পরিচয় দিয়েছেন। এদের রচনা সংখ্যা সীমিত হলেও বিষয়বস্তু ও শিল্পগত দিক থেকে স্মরণীয়। ভ্রমণ বিষয়ক প্রথম উল্লেখ্য রচনা ‘আর্যবর্ত্য’(১২৯৫)। লেখিকা প্রসন্নময়ী দেবী। পরিমল গোস্বামীর এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান - ‘পথে পথে’ । স্মৃতিকথামূলক রচনা এ জেলায় কিছু পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই বিশিষ্ট নাম প্রসন্নময়ী দেবী। এর রচনা-‘পূর্ব স্মৃতি’। এরপর আত্মকথা লিখেছেন প্রমথ চৌধুরী। এতে হরিপুর, পাবনার স্মৃতি রোমন্থন লক্ষিত হয়। এছাড়া বাংলা ১৩৩৩ সালের কার্তিক সংখ্যা ‘সবুজ পত্রে’ তিনি ‘পাবনার কথা’ নামে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন। পরিমল গোস্বামীর স্মৃতিচারণমুলক স্মরণীয় সৃষ্টি ‘পত্রস্মৃতি’ ও ‘আমি যাঁদের দেখেছি’। অতীত স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে বন্দে আলী মিয়ার রচনা ‘জীবনের দিনগুলি’। স্মৃতি কথার চেয়ে তুলনামূবকভাবে জীবনচরিত এ জেলায় রচিত অধিক জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে বন্দে আলী মিয়ার ‘জীবন শিল্পী নজরুল’ স্মরণীয়। জীবনকথা বিষয়ক প্রবন্ধে এছাড়া অন্যান্যের মধ্যে পরিমল গোস্বামী, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, আবু লোহানী প্রমুখ বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। অনুবাদের ক্ষেত্রেও এ জেলার অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রসন্নময়ী দেবীর ‘বনলতা’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা ইংরেজী থেকে অনুদিত। কুমুদনাথ চৌধুরী রচিত 'Sports in jheels and jungle’ অনুবাদ করেছেন প্রিয়মব্দা দেবী। এর অনুদিত ‘ঝিলে জঙ্গলে শিকার’ সবুজপত্রের কয়েকটি সংখ্যায় বের হয়। পরিমল গোসাম্বী অনুদিত অন্যতম উল্লেখ্য গ্রন্থ ‘সুখের সন্ধানে’ (মূলঃ বারট্রাগু বাসোল)। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন রুমীর ‘মসনবী শরীফের’ আংশিক অনুবাদ করেছেন। বাণী রায়ের ‘জুপিটার’ কাব্যের কয়েকটি কবিতা ইংরেজী থেকে অনুদিত। এবং অনুদিত গদ্য রচনা- ‘মোনালিসা’, খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে রচিত এপুলিয়াস- এর `Golden ass’ অবলম্বনে আব্দুল গণি হাজারী অনুবাদ করেছেন ‘স্বর্ণ গর্দভ’। এ ক্ষেত্রে তাঁর আর এক উল্লেখযোগ্য প্রয়াস ‘মনসমীক্ষা’ (মূল ফ্রয়েড)। আর্থার মিলার রচিত `Death of a Salesman’ অবলম্বনে ফতেহ লোহানীর রচনা ‘একটি সামান্য মৃত্যু’। ইউীন ও নীল- এর নাটকের অনুবাদ ‘বিলাপে বিলীন’। কবি বন্দে আলী মিঞা শিশু সাহিত্যেও পাবনা জেলার বিশিষ্ট ভুমিকা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এ জেলায় উল্লেখ্য সংখ্যক শিশু সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে প্রসন্নময়ী দেবী, প্রিয়মব্দা দেবী, মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন ও বন্দে আলী মিয়া প্রমুখের নাম করা চলে। এর মধ্যে সংখ্যাগত দিক থেকে বন্দে আলী মিয়ার বইয়ের সংখ্যা পর্যাপ্ত। এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬২ সনে তিনি ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করেছেন। প্রবন্ধের ক্ষেত্রে পাবনা জেলার অবদান ব্যাপক। প্রথমে সাহিত্য সমালোচনা ও গবেষণামূলক প্রবন্ধের কথা আলোচনা করা যেছে পারে। এতে প্রমথ চৌধুরী, মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন, ডঃ আবু হেনা মোসতফা কামাল ও জিয়া হায়দার প্রমুখের নাম স্মরণীয়। বাংলা গদ্যের বিবর্তনে ও প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারায় প্রমথ চৌধুরীর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রবন্ধ সাহিত্যে তাঁর অনবদ্য অবদান ‘বীরবলের হালখাতা’, ‘নানা কথা’, ‘নানা চর্চা’। বাগবৈদগ্ধ্য তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর আধুনিক সাহিত্যের ওপর গবেষণায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন ডঃ আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ডঃ আবু হেনা রচিত গবেষণা নিবন্ধ- `The Bengli press and Literary writings, ১৮১৮-১৮৩১ ও সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘শিল্পীর রুপান্তর’-এ মনস্বিতার পরিচয় মেলে। রম্য রচনার ক্ষেত্রে পরিমল গোস্বামী বিশেষ সিদ্ধহস্ত। নির্মল কৌতুকের প্রচ্ছন্ন লক্ষিত হয় তাঁর রচনায়। পাবনা জেলার সাহিত্য সাধনার নেপথ্যে সাময়িক পত্রের অবদান্ত কম নয়। অনেক সাময়িকী এ জেলা থেকে বের হয়েছে। এর মধ্যে ‘পাবনা দর্পণ’, ‘উদ্যোগবিধায়নী’, ‘আশালতা’, ‘সৎসঙ্গী’, ‘সাম্যবাদ’, ‘সুরাজ’, ‘আমাদের দেশ’, ‘যমুনা’, ‘প্রবাহ’ ও ‘বিবৃতি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া এ জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, নানা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত কিংবা যৌথ উদ্যোগে বেশ কিছু বার্ষিকী ও স্মরণিকা বের হয়েছে। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে, সাহিত্যক্ষেত্রে পাবনা জেলার ভুমিকা শুধু ব্যাপকইনয়, সুদুরপ্রসারী প্রভাববাহীও বটে। সাহিত্য অংগনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অংগনেরও অনেক কৃতি মানুষের জন্ম হয়েছে পাবনায়। এদের অনেকেই জাতীয় পর্যায়ে শুধু নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সঙ্গীতে বারীণ মজুমদার, ইলা মজুমদার, প্রমথনাথ চৌধুরী, আব্দুল গফুর, সত্য মজুমদার, মনোয়ারা বেগম, ডলি সায়ন্তনী, বাদশা বুলবুল উল্লেযোগ্য। এছাড়াও অন্য জেলায় জন্মগ্রহণ করলেও চাকরী/কর্ম সূত্রে পাবনাতে দীর্ঘদিন অবস্থানকালীন সময়ে সাহিত্য সাধনা করেছেন এমন সাহিত্যিকদের সংখ্যাও কম নয়। তন্মধ্যে সরদার আব্দুল হামিদ, কবি আশুতোষ বড়ুয়া প্রমুখ। কিংবদন্তি নায়িকা সূচিত্রা সেন অভিনয় শিল্পকে আলোকিত করেছেন অনেকেই। যেমনঃ সুচিত্রা সেন, তপন লাহিড়ী, আবুল হোসেন, তেজেন চক্রবর্তী, নিশি বকশী। এর মধ্যে অত্যন্ত গর্বের সাথে উল্লেখযোগ্য নাম উপমহাদেশের কিংবদন্তি নায়িকা সূচিত্রা সেন। তার বাবা করুনাময় দাশ গুপ্ত। চাকরি করতেন পাবনা পৌরসভায়। সূচিত্রা সেন বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে বাস করতেন পাবনায়। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন পাবনা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পাবনাবাসি বর্তমানে পাবনা শহরের পুরান টেকনিক্যাল স্কুলের রাস্তার উত্তরে অবস্থিত তার পৈত্রিক বাড়ীকে কেন্দ্র করে সূচিত্রা সেন এর স্মৃতি রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন