১৯৪৭ সনে দ্বিজাতি-তত্বের ভিত্তিতে ভারত বর্ষ বিভক্ত হয়। অবৈজ্ঞানিক দ্বিজাতী-তত্ব অসার প্রমাণিত হয়। বাঙ্গালী জাতীয়বাদের উন্মেষ ঘটে। ১৭৭১ সনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিপুল রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। রক্তমূল্যে স্বাধীনতায় পাবনা জেলার অবদান উল্লেখযোগ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাবনা জেলা ছিল ৭নং সেক্টরের অধীন। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন লেঃ কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান। পাবনা জেলা স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে শেষ পর্যমত গৌরবজ্জল ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে অবদান রেখেছে এ জেলার সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ও সর্বস্তরের জনগণ। অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এ জেলার হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। বার বার মোকাবেলা করেছে পাক-হানাবার বাহিনীকে। মুক্ত রেখেছে জেলার বেশ কিছু স্থান। এ জেলার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন ছাত্র-জনতা, রানৈতিক নেতা-কর্মী, সর্বস্তরের জনতা ও পাবনায় অবস্থানরত সকল পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। অনেক নেতা-কর্মী পালন করেছেন সংগঠনের গুরু দায়িত্ব।
পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের সচিত্র বনর্না
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ শুক্রবার সকাল থেকে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী পৈশাচিক আক্রমন শুরু করল পাবনার সাধারণ মানুষের উপর। শহরে থাকা নিরাপদ নয় বুঝতে পেরে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ শহরের উপকন্ঠে চর এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সহিত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকবাহিনীকে মোকাবেলা করার শপথ গ্রহণ করেন পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান। এখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করেছেন যারা, আমজাদ হোসেন এমএনএ, আব্দুর রব বগা মিয়া, এ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন, এ্যাডভোকেট আমজাদ হোসেন, ওয়াজ উদ্দিন খান, এ্যাডভোকেট গোলাম আলী কাদেরী, নবাব আলী মোল্লা, ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম বকুল, (পাবনার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান) ইকবাল হোসেন, আব্দুস ছাত্তার লালু, সোহরাব উদ্দিন সোবা, রিদ্দিক আলী, বেবী ইসলাম প্রমূখ।
১৭৭১ সালের ২৮শে মার্চ ভোর রাত্রে পাকহানাদার বাহিনী পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমন করে। পাবনার অকুতভয় পুলিশ বাহিনী জীবন বাজী রেখে পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমন প্রতিহত করে। পাবনার পুলিশ লাইনের যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সহিত পাবনার ছাত্র-জনতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বিপুল পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করে পাকবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পাকহানাদার বাহিনী পুলিশ লাইন থেকে পিছু হটে তাড়াশ বিল্ডিং সংলগ্ন টেলিফোন একচেঞ্জে এসে পজিশন নেয়। সকাল ৯.০০ ঘটিকার সময় রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাবনার ছাত্র-জনতা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ টেলিফোন একচেঞ্জে অস্থানরত পাকহানাদার বাহিনীর উপর আক্রমন চালায়। এই যুদ্ধে প্রায় অধিকাংশ পাকহানাদার মৃতুবরণ করে এবং কিছু সংখ্যক পাকহানাদার গুলি করতে করতে শহরের বিভিন্ন প্রামেত চলে যায়। পাবনা শহরের ময়লাগাড়ী নামক স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর সহিত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতার যুদ্ধ সংগঠতি হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন পাকহানাদার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। পাবনা প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠিত হয় ১৭টি স্থানে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য পাবনা পুলিশ লাইন, টেলিফোন একচেঞ্জ, ময়লাগাড়ী, সার্কেট হাউস সংলগ্ন কাঠের ব্রীজ, বিসিক, মাধপুর বটতলা, ঈশ্বরদী বিমান বন্দর, দাশুড়িয়া তেতুল তলা, মূলাডুলি, মালিগাছা উল্লেখযোগ্য। ২৫শে মার্চ রাত্রিতে পাবনায় পাঠানো প্রায় ১৫০জন পাক হানাদার বাহিনীর সকলেই নিহত হয়। ১৩ দিন পাবনা মুক্ত ছিল। ১৩ দিন পাবনা মুক্ত থাকার পর পুনরায় ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকহানাদার বাহিনী পুনরায পাবনায় ঢোকার মুখে নগরবাড়ী ঘাটে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র জনতার উপর জলে স্থলে ও আকাশ থেকে আক্রমন চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা টিকতে না পেরে পিছু হটে আশে পাবনায়। কিছু মুক্তিযোদ্ধা পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার ডাব বাগান নামক স্থানে অবস্থান নেয়। সেখানে পাকহানাদার বাহিনীর সহিত তুমূল যুদ্ধে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। পাকহানাদার বাহিনীর ১৩ জন সদস্য নিহত হয়। ঐ যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ঐ স্থানের নামকরণ করা হয়েছে শহীদনগর। পুনরায় পাকবাহিনী পাবনা দখল করায় মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র জনতা ভারতে গমন করে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাবনায় প্রবেশ করে এবং পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতির্ন হয়।
ঈশ্বরদী থানা
পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার উল্লেখযোগ্য যুদ্ধস্থান জয়নগর ও ঈশ্বরদী বিমান বন্দর। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন কোম্পানী কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম মন্টু, সদরুল হক সুধা, আজমল হক বিশ্বাস, নুরুজ্জামান বিশ্বাস, শামছুর রহমান শরিফ ডিলু প্রমুখ।
আটঘরিয়া থানা
পাবনা জেলার আটঘরিয়া থানার বংশীপাড়া নামক স্থানে পাকহানাদার বাহিনীর সহিত সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ আটঘরিয়া থানার মধ্যে সর্ববৃহৎ লড়াই বা উল্লেখযোগ্য। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন বিএলএফ কমান্ডার আনোয়ার হোসেন রেনু, এফএফ কমান্ডার ওয়াসেফ আলী, আশরাফ আলী, জহুরুল হক প্রমূখ।
চাটমোহর থানা
পাবনা জেলার চাটমোহর থানার উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সংগঠতি হয় চাটমোহর থানা দখলের যুদ্ধে। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মোজাম্মেল হক ময়েজ, এস.এম মোজাহারুল ইসলাম, চঞ্চল প্রমূখ।
ভাঙ্গুড়া থানা
পাবনা জেলার বর্তমান ভাঙ্গুড়া থানার বড়াল ব্রীজ নামক স্থানে ও দিলপাশার নামক স্থানে উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার হান্নান সাহেব, আসলাম, মকছেদুর রহমান প্রমূখ।
পাবনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বুকলের নাম। পাবনা জেলার সকল এলাকার যুদ্ধকালীন কমান্ডারদের সমন্বয়কারী, যুদ্ধের পরিকল্পনাকারী ও সর্বপোরী পাবনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাবনার মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক রফিকুল ইসলাম বকুলকে শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করি। সেই সঙ্গে স্মরণ করি সকল শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের।
১৫ই ডিসেম্বর পাবনা শত্রু মুক্ত হয়। পাবনার বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পত পত করে উড়তে থাকে।
অনেক উপকারি পোস্ট। ধন্যবাদ আপনাদের সাবাইকে।
উত্তরমুছুন